আমেরিকার “নাসা”-র দ্বারা পাঠানো মহাকাশে স্যাটেলাইট “ভয়েজার ১” আজ মহাকাশের নানান তথ্য বিজ্ঞানীদের আছে পাঠিয়ে চলে যাচ্ছে।
সৌরজগতের প্রান্তসীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে এই স্যাটেলাইটটি। ৩৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাগবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার উৎক্ষেপণ করা নভোযান ভয়েজার ১ এখন সৌরজগতের এক প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে ।
ভয়েজার ১ ‘সায়েন্স’ সাময়িকীতে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছিল, বর্তমানে পৃথিবী থেকে সাড়ে ১৮ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করছে এই নভোযানটি।
“ভয়েজার ১”
“ভয়েজার ১”, ২০২৫ সালে আমাদের সঙ্গে সকল যোগাযোগ ছিন্ন করে চিরতরে হারিয়ে যাবে। এই সুবিশাল মহাকাশের কোনও এক অজানা জায়গায়। আজ থেকে ৪২ বছর আগে ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সালে লঞ্চ করা হয়েছিল “ভয়েজার ওয়ান”। স্পেস বা মহাকাশ সম্পর্কে আপনি জেনে থাকেন তবে এই নভোযানটির ব্যাপারে নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন । ভয়েজার ওয়ান স্পেস ক্রাফট মানুষের বানানো প্রথম মহাকাশযান। পৃথিবী থেকে সবথেকে দূরে অবস্থান করছে।
বর্তমানে পৃথিবী থেকে প্রায় ২ হাজার ৩২৭ কোটি ৪৪ লক্ষ ১১ হাজার ২৬২ কিলোমিটার দূরে রয়েছে। কিন্তু এত দূরে যাওয়া সত্ত্বেও আজ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছে । কিন্তু এখন প্রশ্ন হ’ল কতদিন এবং কতদূর পর্যন্ত আমরা ভয়েজার ওয়ান-কে ট্র্যাক করতে পারবো? তবে কি কখনো ভয়েজার ওয়ান এর সিগনাল আসা বন্ধ হয়ে যাবে?
দিনটি ছিল ১৯৭৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কেপ কেনাভারাল এয়ার ফোর্স স্টেশন থেকে উৎক্ষেপণ করা হল একটি রকেট, যার মধ্যে সুরক্ষিত রয়েছে একটি স্পেস প্রোব, নাম- “ভয়েজার ১”।
পৃথিবীর আকর্ষণ শক্তিকে উপেক্ষা করে ছুটে যেতে থাকে “Titan IIIE” নামের রকেটটি, যার ভেতর রয়েছে মানব ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করার সেই যন্ত্র। একটি নির্দিষ্ট সময় পর রকেটের ভেতর থেকে মহাশূন্যে বেরিয়ে আসে ভয়েজার ১। এরপরই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে সীমাহীন এই মহাকাশের বুকে। মূলত স্পেস প্রোব হচ্ছে কম্পিউটার চালিত মহাকাশযান, যা সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়।
এই “ভয়েজার ১” মিশনের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের সৌরজগতের বৃহৎ দুই গ্রহ – বৃহস্পতি এবং শনি সম্পর্কে আরও তথ্য জোগাড় করে বিজ্ঞানীদের আছে পাঠানো। এছাড়া বৃহস্পতির চাঁদ টাইটানের আবহাওয়া, ম্যাগনেটিক ফিল্ড, এবং অন্যান্য উপগ্রহগুলি পরীক্ষা করাও ছিল এই মিশনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৫ মার্চ ১৯৭৯ সাল – ”ভয়েজার ১” গ্যাস দানব বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছে পৌঁছে যায়। বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে যে রিং সিস্টেম রয়েছে, তা আমরা এই মিশন থেকে পাঠানো ছবি থেকে প্রথম জানতে পারি। এছাড়া বৃহস্পতি গ্রহে প্রায় ৩৫০ বছর ধরে ঘটে চলা ঘূর্ণিঝড় ‘গ্রেট রেড স্পট’-এর ছবি এবং ছোট ভিডিও সংস্করণ তুলে পাঠায় ভয়েজার ১। ঝড়টি এতই বড় যে, এতে অনায়াসে পৃথিবীর মতো গ্রহ এঁটে যাবে। “ভয়েজার ১” কেবল বৃহস্পতিরই প্রায় ১৯ হাজার ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে।
এই মিশনের সাহায্যে আরও জানা গেছে – বৃহস্পতির চাঁদ ‘আইও’-তে রয়েছে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, যার লাভা উদগীরণ ঘটে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত ওঠে। এছাড়া ‘ইউরোপা’ ও ‘গ্যানিমেড’ পর্যবেক্ষণে জানা যায়, এদের পুরু ভূপৃষ্ঠের নিচে রয়েছে তরল সমুদ্র। তাছাড়া এটি বিভিন্ন উপগ্রহের ছবিও পাঠায়।
বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথ ছেড়ে ১২ নভেম্বর ১৯৮০ সালে এটি শনিগ্রহের কাছে পৌঁছয়। এরপর শনির রিং বা বলয়ের সবচাইতে হাই রেজুলেশন ছবি পৃথিবীতে পাঠাতে থাকে।
ভয়েজার শনির উপগ্রহ টাইটানের বহু ছবি তোলে এবং এর আবহাওয়া নিয়েও পরীক্ষা করে। ‘টাইটান’ আকারে আমাদের সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ, আবার সৌরজগতের একমাত্র ঘন বায়ুমণ্ডলবিশিষ্ট উপগ্রহ। এর বায়ুমণ্ডল মূলত নাইট্রোজেন দিয়ে তৈরি। ঘন বায়ুমণ্ডলের কারণে এর ভূপৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল ভয়জারের। তবে এর নিচে মিথেনের নদী থাকতে পরে বলে ধারণা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
এরপর “ভয়েজার ১” শনি গ্রহের আকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সৌরজগত অতিক্রম করার মতো গতিশক্তি লাভ করে। অবশেষে ২০১২ সালের আগস্ট মাসে এটি আমাদের সৌরজগত অতিক্রম করে “ইন্টারস্টেলার স্পেসে” প্রবেশ করে। “ইন্টারস্টেলার স্পেস” হচ্ছে দুটি তারার মধ্যবর্তী দূরত্ব যেখানে কোনও গ্রহ-উপগ্রহ বা অন্যান্য কিছুর অস্তিত্ব নেই। এর প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশই অন্ধকার।
ভয়জার ১-এর যোগাযোগ ব্যবস্থা
“ভয়েজার ১” তৈরির সময় যে প্রযুক্তি ছিল তার সর্বোচ্চ দিয়েই এটি তৈরি করা হয়েছিল। এতে রয়েছে ১২ ফুট ব্যাসের একটি এন্টেনা। এছাড়া আছে একটি রেকর্ড, যা সর্বোচ্চ ৬৭ মেগাবাইট তথ্য ধারণ করতে পারে। ব্যাপারটি আমাদের কাছে বর্তমানে কিঞ্চিৎ মনে হলেও আদতে এটি অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। “ভয়েজার ১” প্রাপ্ত তথ্য এই অল্প জায়গাতেই জমা করে রাখে এবং পরে তা পৃথিবীতে পাঠায়। এর ক্যামেরা ও অন্যান্য কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে এর মধ্যে থাকা একটি ডিজিটাল কম্পিউটার। মূলত এর সমস্ত কাজ করা এবং একে নিয়ন্ত্রণ করার সকল নির্দেশনা এই কম্পিউটারে আগে থেকেই প্রোগ্রাম করে রাখা হয়েছে। এছাড়া এতে রয়েছে অতিবেগুনি রশ্মি, কসমিক রশ্মি ও প্লাজমা তরঙ্গ মাপার যন্ত্রসহ আরও অনেক উপকরণ। এটি প্রায় ৬৫ হাজার আলাদা আলাদা যন্ত্রের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে।
এর সিগনাল পৃথিবীতে আসতে প্রায় ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা সময় লাগে। এই তথ্য গ্রহণ করতে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসিয়েছেন কিছু রাডার। এসব রাডার থেকে ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতার রেডিও সিগন্যাল পাঠানো হয় “ভয়েজার ১”-এর দিকে এবং তা ২০ ঘণ্টা পর “ভয়েজার ১”-এর কাছে পৌঁছয়। “ভয়েজার ১” এই সিগন্যাল পাওয়ার পর আরও একটি সিগন্যাল পৃথিবীর দিকে পাঠায়। কিন্তু তা পৃথিবীতে আসতে আসতে এতটা দুর্বল হয়ে পরে যে তা ডিটেক্ট করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই নাসার বিজ্ঞানীরা ‘ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক’ ব্যবহার করে সেই ফ্রিকোয়েন্সি সঠিকভাবে ডিকোড করতে পারেন।
দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছরের যাত্রায় “ভয়েজার ১”-এর অনেক যন্ত্রাংশই পুরনো হয়ে গিয়েছে। তাই বিজ্ঞানীরা এর কিছু যন্ত্রাংশ বন্ধ করে দিয়েছেন। যেহেতু বর্তমানে এটি অন্ধকার জগতে, তাই এর ক্যামেরা বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে একে গরম রাখার জন্য এর কিছু কিছু যন্ত্রাংশ চালু রাখা হয়েছে। এর চারটি কম্পোনেন্ট এখনোও চালু রাখা আছে যা ম্যাগনেটিক ফিল্ড ও সোলার উইন্ড পরীক্ষার কাজে ব্যবহার হয়।
“ভয়েজার ১” আমাদের সৌরমণ্ডল অতিক্রম করার কয়েক মুহূর্ত আগে নিজের ক্যামেরাটি আমাদের পৃথিবীর দিকে ঘুরিয়ে নেয়। এরপর এটি আমাদের পৃথিবীর একটি ছবি তুলে পাঠায়। নিচের ছবিতে যে ছোট বিন্দু দেখতে পাচ্ছেন, সেটি হচ্ছে আমাদের এই নীল গ্রহ “পৃথিবী”।ছবির এই বিন্দুকে বলা হয় – “পেইল ব্লু ডট”।
এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় – এই বিশাল মহাবিশ্ব ব্রম্মান্ডে আমাদের অবস্থান কতটা ক্ষুদ্র। ছবিটি ১৯৯০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী থেকে প্রায় ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূরে তুলেছিল “ভয়েজার ১”। এরপর ভয়েজার ১ আমাদের সৌরজগতের সীমানা অতিক্রম করে প্রবেশ করে “ইন্টারস্টেলার স্পেসে”।
পরবর্তীতে কি হবে ভয়েজার ১-এর ?
আনুমানিক আগামী ৩০০ বছরের মধ্যে ভয়েজার ১ “ওর্ট ক্লাউডে” প্রবেশ করবে। ওর্ট ক্লাউড অতিক্রম করতে প্রায় ৩ হাজার বছর লাগবে। এই ওর্ট ক্লাউড হচ্ছে সূর্যের চারদিক থেকে প্রায় এক লক্ষ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরে অবস্থান করা ধূমকেতু এবং গ্রহাণুপুঞ্জের বেষ্টনী। প্রসঙ্গত, অ্যাস্ট্রোনোমিকাল ইউনিট হ’ল পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের সমান পথ, যা প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার। সেকেন্ডে প্রায় ১৭ কিলোমিটার বেগে এটি মহাকাশে ছুটে চলেছে।নিচের দেওয়া ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনি দেখতে পাবেন “ভয়েজার ১”-এর “রিয়েল টাইম জার্নি” সম্পর্কে।
https://voyager.jpl.nasa.gov/mission/status/
‘নাসা’-র বিজ্ঞানীদের মতে, ভয়েজার ১ তার নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে যাবে। মহাকাশের কোনও বস্তুর সঙ্গে এর আঘাত লাগার সম্ভাবনা নেই। কারণ এটি নিজে থেকেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ভয়েজার ১-কে শক্তি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ‘প্লুটোনিয়াম’। তবে এর শক্তি ক্রমশ কমে আসছে। তাই শীঘ্রই এর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এটি ২০২৫ সাল পর্যন্ত এর ন্যূনতম ১টি যন্ত্র সচল রাখতে পারবে।
”গোল্ডেন ডিস্ক”
“ভয়েজার ১”-এ একটি এমন ডিস্ক রাখা আছে যার সম্মন্ধে জানলে অবাক হবেন। দুটো ভয়েজার মহাকাশযানের সঙ্গেই রয়েছে একটি “গোল্ডেন ডিস্ক”। এই গোল্ডেন ডিস্ক হ’ল সোনার প্রলেপ দেওয়া তামার তৈরি ডিস্ক, যার মধ্যে আমাদের পৃথিবীর বিভিন্ন তথ্য রেকর্ড করে রাখা হয়েছে।
এই ডিস্কে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাণীর শব্দসহ অন্যান্য শব্দ, গান, পৃথিবীর ৫৪টি ভাষার সম্ভাষণ এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য রেকর্ড করে দিয়েছেন। এতে বাংলা ভাষায় রেকর্ড করা আছে— “নমস্কার, বিশ্বে শান্তি হোক”।
সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থান কোথায় সেই বিষয়ে উল্লেখ আছে এই ডিস্কে। বিজ্ঞানীদের আশা – মহাবিশ্বের কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী বা এলিয়েন্স যদি এই গোল্ডেন ডিস্ক পেয়ে থাকে, তবে তারা আমাদের পৃথিবী এবং আমাদের সম্পর্কে জানতে পারবে। তারা যাতে এই ডিস্কটি চালাতে পারে তার সমস্ত কিছুর নির্দেশনা এই ডিস্কে দেওয়া হয়েছে। এই “গোল্ডেন ডিস্ক” বিজ্ঞানী কার্ল সেগেনের নেতৃত্বে তৈরি করা হয়।
এখন “ভয়েজার ১” তার মিশন শেষ করে ফেলেছে, কিন্তু এখনও সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে বিরামহীনভাবে। এটি আমাদের সৌরজগতের পরিধি অতিক্রম করে প্রবেশ করেছে “ইন্টারস্টেলার স্পেসে”, যেখানে রয়েছে কেবলই অন্ধকার। অসীম মহাকাশের বুকে অন্তিম যাত্রা করতে থাকবে “ভয়েজার ১”, আর বহন করতে থাকবে পৃথিবীবাসীর ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সৃষ্টি।
Fourteen Science Desk