মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বিজয় শেখর শর্মা। ছোটবেলা থেকেই অর্থের গুরুত্ব জানতেন। তিনি যখন পড়াশোনা করছিলেন, তখন বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। কলেজে পড়াকালীন ক্লাসে যাওয়ার বদলে সফল মানুষ, বিশেষ করে সফল ব্যবসায়ীদের জীবনী পড়তেন কলেজের লাইব্রেরিতে বসে। সেসব সাফল্যের কাহিনী পড়ে তিনি একটি বিষয় বুঝতে পেরেছিলেন যে, “জীবনে যদি বড় হতে হয়, তাহলে অবশ্যই অন্যের অধীনে থাকা যাবে না। নিজেকে নিজের বশে আনতে হবে, উদ্যোক্তা হতে হবে।”
সাধারণ স্কুল শিক্ষকের ছেলে বিজয় শেখর শর্মার জন্ম হয় ১৯৭৩ সালের ৮ জুলাই, উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে৷ বিজয়ের জীবনের প্রথম অধ্যায় কেটেছে বেশ কষ্টে, অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন দিনের পর দিন খেয়ে না খেয়ে। কিন্তু, ২০১০ সালে জীবনের গল্প পালটে যায় তাঁর, প্রতিষ্ঠা করেন পেটিএম (Paytm). গুগল প্লে স্টোর থেকে এই অনলাইন পেমেন্ট অ্যাপটি ডাউনলোড করা হয়েছে প্রায় ১০ কোটি বারেরও বেশি এবং বর্তমানে এই অ্যাপটি থেকে দিনে কোটি টাকারও বেশি লেনদেন হয়।
এই অ্যাপ প্রতিষ্ঠার পর পরই বিলিওনিয়ার হয়ে যান বিজয়। ওয়ারেন বাফেটের মতো লোক বিজয়ের বিজনেস পার্টনার৷ শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন বিজয়, আজ তাঁর এই সাফল্যের শিখরে পৌঁছানোর ধাপগুলো যথেষ্ট কঠিন এবং মোটেই সুবিধের ছিল না।
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন বিজয়। স্কুলের স্যারদের কাছে রীতিমতো জিনিয়াস ছিলেন তিনি। মাধ্যমিকে দুর্দান্ত ফলাফলের পর উচ্চমাধ্যমিক পড়ার বদলে তাঁর সুযোগ হয়ে যায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। দিল্লি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হন তিনি। তবে, কলেজে ভর্তির পর বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় বিজয়কে। স্কুলের পড়াশোনা ছিল তাঁর হিন্দী মাধ্যমে। কিন্তু, কলেজ ছিল পুরোপুরি ইংরেজি মাধ্যমে। কলেজের স্যারদের পড়ানো, লেকচার কিছুই বোধগম্য হত না তাঁর। কলেজের স্যাররা কোনও প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারতেন না বিজয়, প্রশ্নের অর্থই যে বুঝতে পারতেন না তিনি। ফলত, স্যারদের বকুনি খাওয়া ছিল নিত্য ব্যাপার, অপদস্ত হতে হত তাঁর সহপাঠীদের মাঝে। হতাশ হয়ে পড়েন বিজয়। ক্লাসে যাওয়াই ছেড়ে দিলেন বাধ্য হয়ে। তার বদলে প্রচুর ইংরেজি বই পড়তে লাগলেন কলেজের লাইব্রেরিতে গিয়ে।
কলেজে পড়াকালীনই বিজয় আর তাঁর এক বন্ধু মিলে একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন। নাম দেন indiasite.net. এটি ছিল ভারতীয় ওয়েবসাইট খোঁজার একটি সার্চ ইঞ্জিন। বেশ ভালো পারফর্ম করছিল তাঁদের এই ইন্ডিয়াসাইট.নেট। প্রায় ২ বছর পর এক আমেরিকান কোম্পানি সাইটটি ১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নেয় তাঁদেরচকাছ থেকে। ওয়েবসাইট বিক্রির টাকা পুরোটাই জমিয়ে রেখেছিলেন বিজয়। তারপর এক বছর ধরে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করে আরও কিছু টাকা জমিয়ে ফেলেন। তারপর ২০০০ সালে ‘one 97’ নাম দিয়ে খুলে ফেলেন নিজস্ব একটি কোম্পানি। এই কোম্পানির কাজ ছিল মূলত গ্রাহকদের কাছে বিভিন্ন মানুষের তথ্য জোগাড় করে দেওয়া। বিশেষত, অজানা কোনও নম্বর থেকে ফোন এলে গ্রাহক সেই নম্বরটি ওয়ান নাইন্টি সেভেনকে পাঠালে সেই কোম্পানি ওই অজানা ব্যক্তির নাম এবং ঠিকানা বের করে দিত। বেশ ভালোই চলছিল কোম্পানি তবে এমন একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগের পরিমাণও বেশ ভালোই করতে হয়। বিজয়ের সেই খরচ কুলোতে বেশ চাপ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে চড়া সুদে লোন নেন তিনি। কিন্তু, তা নিয়েও মিটল না সমস্যা। কোম্পানি থেকে যা আয় হত তা দিয়ে নিজের থাকা, খাওয়া, অফিস ভাড়া, অফিস কর্মীদের বেতন দিতে দিতেই সব শেষ হয়ে যেত।
সেইসময় কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় বিজয় শেখরকে। বাসা ভাড়া দিতে পারতেন না, বাড়ির মালিকের সঙ্গে যাতে মুখোমুখি না হতে হয় তার জন্য প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরতেন তিনি, আবার ভোর হতেই বেরিয়ে পড়তেন বাড়ি থেকে। শুধুমাত্র চা আর জল খেয়ে থেকেছেন বেশ কিছুদিন অথবা কোনও বন্ধুর বাড়িতে এক বেলা খেয়েছেন। এত কষ্ট করার পরেও কোম্পানি চালু রাখার মত টাকা তাঁর হাতে থাকত না। এরপরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফ্রিল্যান্স সফটওয়্যার ডেভেলপার হিসেবে কনসাল্টেন্সির কাজ করবেন। এরকমই একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সূত্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় বিখ্যাত ধনী ব্যবসায়ী পীযূষ আগরওয়ালের সঙ্গে। আগরওয়ালের ব্যবসার তখন মন্দা পরিস্থিতি। বিজয় শেখর তাঁর কোম্পানিতে কাজ শুরু করার পর পীযূষের ব্যবসা ব্যাপক লাভ করা শুরু করে। পীযূষ সেই সময় বুঝতে পারেন, এই মেধাবী লোকটাকে সঠিক কাজে লাগাতে পারলে তাঁর কোম্পানি অনেক দূর এগোবে৷ বিজয়কে কোম্পানির সিইও হওয়ার প্রস্তাব দেন পীযূষ। কিন্তু, বিজয় সেই প্রস্তাব বিনীত ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমার তো নিজের একটি কোম্পানি আছে৷ আমার লক্ষ্য হল সেটাকে বড়ো করা৷ এই কারণেই আমি আপনার প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারছি না।”
কিন্তু, বিজয় যেমনটা ভেবেছিলেন, তেমনটা হল না। তাঁর আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যেতে লাগল। পরিবার থেকে চাপ আসে এসব বাদ দিয়ে একটা ভালো চাকরি জোটানোর চেষ্টা করার জন্য। আর্থিক এবং পারিবারিক ঝক্কি সামলাতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েন বিজয় শেখর। অবশেষে আর কোনও রাস্তা না পেয়ে ফের পীযূষের কাছে ফিরে যান তিনি। বলেন যে, একটি শর্তেই তিনি তাঁর কোম্পানির সিইও পদে যোগ দিতে পারেন। শর্ত ছিল যে, দিনের অর্ধেক সময় তাঁকে তাঁর নিজস্ব কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। রাজি হয়ে যান পীযূষ। মাসিক ৩০ হাজার টাকা বেতনে কাজ সিইও পদে কাজ শুরু করেন বিজয়।
বিজয়ের অসাধারণ কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে যান পীযূষ৷ কিন্তু, বিজয় ব্যাংকের চড়া সুদের জালে ফেঁসে যান, কিছুতেই পুরোপুরি মেটাতে পারছিলেন না সুদের টাকা। সেই সময় ৮ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিজয়ের কোম্পানির ৪০ শতাংশ কিনে নেন পীযূষ। ফলত, কিছুটা হালকা হন বিজয়। কিছুদিনের মধ্যে ধাতস্থ হয়ে বিজয় এবার অন্যদিকে মন দিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, স্মার্টফোন দিনে দিনে মানুষের জীবনের একটা বড় অংশ হয়ে উঠছে৷ তিনি ঠিক করে ফেললেন, এমন একটি অনলাইন অ্যাপ তৈরি করবেন যা দিয়ে মানুষ স্মার্টফোনের মাধ্যমে টাকাপয়সা লেনদেন করতে পারবে। অবশেষে ২০১০ সালের ৮ জুলাই, নিজের ৩৭তম জন্মদিনে তিনি চালু করলেন পেটিএমের ওয়েবসাইট।
এই অ্যাপ চালু হওয়ার প্রথম দিকে শুধুমাত্র মোবাইলে টাকা রিচার্জ করার সুবিধা পাওয়া যেত। পরে আস্তে আস্তে এর মাধ্যমে কারেন্টের বিল দেওয়া, টাকা লেনদেন করা, বাস, ট্রেনের টিকিট বুক করার মতো সুবিধাগুলো যোগ হয় এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে পেটিএম জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই অ্যাপটি প্রায় আড়াই কোটি নিয়মিত গ্রাহক পেয়ে যায়। মানুষ অনলাইন পেমেন্টের ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডের বিকল্প হিসেবে পেটিএম ব্যবহার করতে শুরু করল। বর্তমানে, পেটিএমের অনলাইন ব্যাংকও রয়েছে এবং এর বাৎসরিক আয় ৮১৪ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, গত বছর ওয়ারেন বাফেটের বার্কশায়ার হাথওয়ে প্রায় আধা বিলিয়ন ডলার বিজয় শেখরের কোম্পানি ওয়ান নাইন্টি সেভেনে বিনিয়োগ করেছে।
এই বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়েও বিজয় শেখর অতি সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এত বড় কোম্পানির সিইও হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজের কোনও আলাদা চেম্বারে বসেন না। সবার সঙ্গে একই ডেস্কে বসে সাধারণ কর্মীর মতো কাজ করেন৷ তাঁর হার না মানা মনোভাব, হতাশার মধ্যেও অনুপ্রেরণা খোঁজার গুণকে পাথেয় করে আজ তিনি এই জায়গায় পৌঁছেছেন। না খেয়ে দিন কাটানোর পরেও স্বপ্ন দেখে গেছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর স্থির লক্ষ্য এবং শক্তিশালী মন বহু তরুণ মনকে অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা রাখে।