একপেশে প্রেমের কারনেই গৃহবধূ সুপ্রিয়া দত্তকে বেঘোরে প্রাণ দিতে হলো! বাস্তবিকই সুপ্রিয়াদেবীর সঙ্গে কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্ধার প্রবাল সরকার ‘পুতুল বিয়ের’ খেলার মতো প্রেমের অভিনয় করেছিলেন। উল্টে প্রবালের কাছে মন প্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন রায়গঞ্জের রবীন্দ্রপল্লির গৃহবধূ সুপ্রিয়া দত্ত। তিনি হয়তোবা স্বপ্নেও ভাবেননি- ভালবাসার দাম যে এভাবে নৃশংসভাবে খুন হয়ে চুকিয়ে দিতে হবে! তাহলে বোধহয় ওপথ মারাতেন না ফুলের মত সুন্দর মনের সুপ্রিয়া।
পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের পর জেনেছে- প্রবালের সঙ্গে সংসার গড়তে চেয়েই নাকি চাপ দিচ্ছিলেন সুপ্রিয়া৷ সেই কারনেই খুন হয়ে থাকতে পারেন রায়গঞ্জের রবীন্দ্রপল্লির গৃহবধু সুপ্রিয়া দত্ত! খুনের কিছুক্ষণ আগেই ব্যাঙ্ক থেকে নগদ টাকা ও লকার থেকে সোনার গয়না তুলে এনেছিলেন সুপ্রিয়া দত্ত৷ তিনি ভেবেছিলেন-সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে প্রবালকে সঙ্গী করে আত্মগোপন করবেন। দূরের কোনও অজানা গাঁয়ে ঘর বাঁধবেন। উল্টে প্রবাল তার কিট ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছিলেন ধারালো ছুড়ি। পুলিশি জেরায় উঠে আসে এমনই এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। তবে কি পরকীয়া সম্পর্কের যবনিকপাত ঘটাতেই সুপ্রিয়াদেবীকে খুন করার ফন্দি আঁটে প্রবাল? এমনটাই মনে করছেন তদন্তকারী পুলিশ অফিসাররা। যদিও মনোবিদেরা এই সম্ভাবনার কথা এর আগেই জানিয়েছিলেন। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে তৈরি হওয়া জটিলতা থেকেই যে সুপ্রিয়া দত্তকে খুন হতে হয়েছে সেই ব্যাপারে নিশ্চিত পুলিশ বলে সূত্রের খবর। যদিও খুনের উদ্দেশ্য নিয়ে এখনও তদন্তকারীদের ধোঁয়াশা কাটেনি। তবে বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের ধারনা- যদি সুপ্রিয়া দত্তের বয়স সত্যই ৪১ বছরই হয়, সেক্ষেত্রে তার স্বামীর বর্তমান বয়স ৫৭ বছর। এক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী-র বয়সের ব্যবধান গিয়ে দাঁড়াল ১৬ বছরে। হয়তোবা সুপ্রিয়াদেবী তুলনায় কম বয়সী সঙ্গীর সঙ্গেই বাকি জীবনটা কাটাতে চাইছিলেন বলে অনুমান পুলিশের একাংশর!
সুপ্রিয়া দত্ত খুন হওয়ার পর তাঁর স্বামী দেবাশীষ দত্ত সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন- ১১ নভেম্বর তাঁর স্ত্রী-র ব্যাঙ্কে যাওয়ার কথা ছিল। ব্যাঙ্কের লকারে তাঁর স্ত্রী-র কিছু কাজ ছিল বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। প্রত্যাশিতভাবেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যাওয়া সুপ্রিয়াদেবী লকারে গচ্ছিত গয়নাগাটি এবং অর্থ একত্রিত করে প্রবালের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাই করেছিলেন বলে অনুমান পুলিশেরও। কিন্তু প্রবাল সুপ্রিয়া দত্তকে নিয়ে স্ত্রী-সন্তানের সামনে মুখ দেখাতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। মনোবিদদের কথায়- এমনই নতুন সম্পর্কের টানা পোড়েনে উভয় সংকটে ভুগে এমনই এক দুঃসাহসিক কান্ড ঘটিয়ে ফেলে থাকতে পারেন চ্যাংড়াবান্ধার অভিযুক্ত প্রবাল সরকার! তিনি বোধকরি স্বপ্নেও ভাবেননি পাছে ধরা পড়ে যাবেন। ‘অপু-দুর্গা’-র রেল গাড়ি দেখার স্বপ্নের মতন, হয়তোবা এটাও ভেবেছিলেন- মায়ের কাছে মার খেতে হয় খাব, থুরি! পুলিশের কাছে ধরা ধরা পড়তে হয় পড়বো, তবুও সুপ্রিয়াকে খুন করেই ছাড়বো! বাস্তবে ‘জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ’ নয়, ঘরে স্ত্রী-পুত্র, সামনে নতুন ঘর বাঁধতে ক্রমাগত চাপ দেওয়া সুপ্রিয়া? শেষমেশ কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্ধা থেকে কয়েকশো কিমি দূরের রায়গঞ্জের রবীন্দ্রপল্লির প্রেমিকা সুপ্রিয়া দত্তকেই এদুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা এঁটে থাকতে পারেন অভিযুক্ত প্রেমিক প্রবাল সরকার! সুপ্রিয়া দত্ত খুনের পূর্ণাঙ্গ বিষয়টি-ই তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের সামনে রহস্য ভেদের জন্য সযত্নে সাজিয়ে রাখা থাকলো।
উল্লেখ্য, ১২ দিন যাবৎ রায়গঞ্জের রবীন্দ্রপল্লির গৃহবধূ সুপ্রিয়া দত্ত খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত ধৃত প্রবাল সরকারকে টানা জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশের হাতে উঠে এসেছে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। পুলিশি সূত্রে জানা গিয়েছে, ব্যাঙ্কের লকার থেকে নিজের সোনার গয়না তুলে এনেছিলেন ১১ নভেম্বর নিজের বাড়িতে নৃশংসভাবে খুন হওয়া সুপ্রিয়া দত্ত। সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে কিছু টাকাও তুলেছিলেন বলে জেনেছেন তদন্তকারী পুলিশ অফিসারেরা। জেরার মুখে প্রবালও পুলিশকে জানায়- সুপ্রিয়া তাকে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য নিরন্তর চাপ দিচ্ছিলেন। কিন্তু বছর কয়েক আগেই প্রবাল সরকারের বিয়ে হয়। ঘরে তার দু’বছরের একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তানও রয়েছে। কার্যত সন্তান হওয়ার পর থেকেই পরকীয়া সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন প্রবাল! আর এখান থেকেই শুরু হয় উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতা।
প্রসঙ্গত, রায়গঞ্জ শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রবীন্দ্রপল্লিতে ১১ নভেম্বর খুন হন সুপ্রিয়া দত্ত নামের ৪১ বছরের গৃহবধূ। এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পাঁচ দিন পর ১৬ নভেম্বর আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটার একটি হোটেল থেকে রায়গঞ্জ থানার পুলিস এই খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত প্রবাল সরকারকে গ্রেফতার করে। প্রথমে তাকে দশ দিনের পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তদন্তকারী পুলিশ অফিসারেরা। প্রথমদিকে অভিযুক্ত প্রবাল মুখে কুলুপ আঁটলেও আটদিনের মাথায় ভেঙে পড়ে প্রবাল। যে ধারালো অস্ত্রটি দিয়ে সুপ্রিয়াদেবীকে খুন করেছিল তা পুলিশকে উদ্ধার করার জন্য সন্ধান দেয় অভিযুক্ত প্রবাল। এরপর পুলিশের সামনে স্বীকার করে হাড় হিম করা একের পর এক সুপ্রিয়া খুনের চাঞ্চল্যকর তথ্য। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ তদন্তের স্বার্থে রবিবার তাকে আদালতে পেশ করে ফের আরও চারদিনের হেফাজতে নেয় পুলিশ। দ্বিতীয় দফায় দু’দিনের মাথাতেই ধীরে ধীরে খুনের ঘটনার সমস্ত তথ্য মেলে ধরতে চলেছে অভিযুক্ত প্রবাল। তদন্তকারী অফিসারদের অনুমান- আজ মঙ্গল এবং আগামীকাল, বুধবারের মধ্যে সবটাই উগড়ে দিতে চলেছে সুপ্রিয়াদেবীর খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্ধার বাসিন্দা প্রবাল সরকার। যদিও খুনের পূর্ণাঙ্গ ঘটনা জানতে উন্মুখ উত্তর দিনাজপুরের মানুষ।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ থেকে বিশেষ প্রতিনিধির রিপোর্ট, টাইমস ফোর্টিন বাংলা।