অবশেষে মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করলেন ঔপন্যাসিক। জন্মভূমিতে এসেই প্রাণ বিসর্জন দিলেন দেবেশ। ‘ষোলো ঘড়িকথা’ সহ অসংখ্য উপন্যাসের স্রষ্টা দেবেশকান্তি চক্রবর্তী। মঙ্গলবার দেবেশবাবুকে শিলিগুড়ির একটি বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকে বেলা দুটো বেজে ৪০ মিনিটে আনা হয় রায়গঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। দীর্ঘ প্রায় ২০০ কিলোমিটারের অ্যাম্বুলেন্সের ধকল নিতে গিয়ে খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অস্ত্রোপচার করে আসা দেবেশকান্তি চক্রবর্তী, তাঁকে দিতে হয় ‘লাইফ সাপোর্ট’-ও। শেষমেষ ১৫ দিন যমে-মানুষে লড়াই করে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন প্রখ্যাত উপন্যাসিক, গল্পকার, লেখক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক,দক্ষ সংগঠক সর্বোপরি ঊনসত্তরের তরুণ দেবেশকান্তি চক্রবর্তী। তিনি রেখে গিয়েছেন স্ত্রী, একমাত্র কন্যা, জামাতা,নাতি সহআত্মীয়- স্বজন সহ অসংখ্য গুনগ্রাহী মানুষকে। আজ,বুধবার তাঁর নশ্বর দেহটি ময়নাতদন্তের পর স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। সৎকারের ভাবনা রয়েছে রায়গঞ্জের বন্দর শ্মশানে। বুধবার সকালে এমন খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তেই অসংখ্য মানুষ একবার গুণী মানুষটিকে শেষবারের মতো দেখতে রায়গঞ্জ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভিড় জমিয়েছেন।
তিনি মাত্র ছ’মাস আগে রায়গঞ্জের উদয়পুরের নিজ বাসভবনটি দোতলা গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল- খানিকটা হাওয়া বাতাসের মধ্যে বসে উপন্যাস লেখা। বাস্তবে দোতলা গড়ার বিষয়টি কার্যত স্বপ্নই থেকে গেল ঔপন্যাসিক দেবেশের। তাঁর রচিত ‘নোনা নদীর বাঁকে’, ‘কনিষ্ক’-সহ বেশ কিছু উপন্যাস ছিল প্রকাশের অপেক্ষায়। তিনি তাঁর পাঠকদের উদ্দেশে লিখে গিয়েছেন ৬৫০টি গল্প, অসংখ্য কবিতা, ছড়া। রায়গঞ্জের সুদর্শনপুর দ্বারিকা প্রসাদ উচ্চ বিদ্যাচক্র থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেই লেখালিখিকে বেছে নিয়েছিলেন দেবেশকান্তি চক্রবর্তী। মাঝে উপলব্ধি করেছিলেন-বেঁচে থাকার রসদ হিসেবে একটি সরকারি চাকরিরও। তাই তিনি নিজেকে বই পড়ার নেশায় ডুবিয়ে রাখতে লাইব্রেরিয়ান এর প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে উত্তর মালদার মালতিপুরে প্রথম গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজে যোগ দেন। পরে রায়গঞ্জ মহকুমা গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক হিসেবে সুনামের সঙ্গে চাকরির মেয়াদকাল শেষ করে অবসর গ্রহণ করেন। রায়গঞ্জের কর্ণজোড়ার সংগ্রহশালা গড়ার কাজেও দেবেশবাবুর অবদান ছিল অপরিসীম। অবসর গ্রহণের পর প্রতিবছর বইমেলাতে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হ’ত দেবেশবাবুকে। এবারও গত ১৪ নভেম্বর সেই বইমেলার মিটিং-এ রায়গঞ্জ পুরসভার সভাকক্ষে যোগ দিতে গিয়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন দেবেশকান্তি চক্রবর্তী। সেই দুর্ঘটনাই তাকে অব্যাহতি দিল না। পারিবারিক সঞ্চয়, স্বজনদের সাহায্য, সামাজিক মাধ্যমে খবর পাওয়া শুভানুধ্যায়ীদের দানও রক্ষা করতে পারলোনা সর্বজন শ্রদ্ধেয় অজাতশত্রু মানুষটিকে। দেবেশ বাবুর মৃত্যুতে গভীর শোক জ্ঞাপন করেছেন রায়গঞ্জের সাংসদ দেবশ্রী চৌধুরী, রায়গঞ্জের প্রাক্তন বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্ত, রায়গঞ্জ পুরসভার পুর-প্রশাসক সন্দীপ বিশ্বাস, উপ-পুর প্রশাসক অরিন্দম সরকার, পশ্চিম দিনাজপুর চেম্বার ও কমার্সের সাধারণ সম্পাদক শংকর কুন্ডু, রায়গঞ্জ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক অতনুবন্ধু লাহিড়ী, উত্তর দিনাজপুর জেলা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার চৌধুরী, উত্তর দিনাজপুর প্রেস ক্লাবের সম্পাদক অলিপ মিত্র, রায়গঞ্জের গবেষক- সাংবাদিক সুনীল চন্দ, রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যানী, হেমতাবাদের বিধায়ক তথা রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সত্যজিৎ বর্মন। শোক বার্তা পাঠিয়েছেন রায়গঞ্জের প্রাক্তন সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি, উদয়পুর উদয়ণ স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কর, উদয়পুর বারোয়ারি পুজো কমিটির মূল কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় ওরফে ধ্রুব সাহা, বিশিষ্ট লেখক প্রশান্ত দেব, সৌরেন চৌধুরী, অর্পিতা গোস্বামী, দীপা চৌধুরী, সুমনা পাল মুখোপাধ্যায়,রাইগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক কমলেশ গোস্বামী- সহ বিশিষ্টজনেরা।
প্রসঙ্গত,দেবেশবাবুরা ছিলেন চার ভাই, দুই বোন। ছোটবেলাতেই মেজদা-কে হারিয়েছিলেন। বাকি দুই দাদা বর্তমানে পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর স্টীল প্যান্ট-এ উচ্চপদে কর্মরত থেকে অবসর গ্রহণ করে দুর্গাপুরেই বসবাস করছেন। বড়দি রয়েছেন বালুরঘাটে। ছোট বোন থাকেন রায়গঞ্জে।
মঙ্গলবার রাত ১টায় প্রাণ হারানো দেবেশবাবুর দেহটি ময়নাতদন্তের পর আত্মীয় পরিজনদের হাতে তুলে দেবেন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপর অন্তিম শ্রদ্ধা জানাতে ক্ষণিকের জন্য শায়িত রাখা হবে। এরপরই স্থানীয় বন্দর শ্মশানে পঞ্চভূতে বিলীন হবেন ঔপন্যাসিক, লেখক, কবি-সাহিত্যিক সাংবাদিক, সঙ্গীতজ্ঞ দেবেশকান্তি চক্রবর্তী।
রায়গঞ্জ থেকে বিজয় কুমার চক্রবর্তীর রিপোর্ট, টাইমস ফোর্টিন বাংলা।