মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িটি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে কপোতাক্ষ নদের পূর্বতীরে অবস্থিত। এখানে বেশ কয়েকটি একতলা ও দোতালা ভবন রয়েছে। মহাকবি ,নাট্যকার,বাংলা ভাষায় সনেট এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮২৮ সালের ২৫ জানুয়ারী যশোর জেলার কপোতাক্ষনদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামের এই বাড়িতেই জনগ্রহন করেন। তাঁর পিত রাজ্ নারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল।
এই বাড়ির স্থাপত্যসমূহ নির্মাণে ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত চুন-সুরকি ও ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে রয়েছে মধুসূদনের পৈতৃক বাড়ি ,তাঁর কাকার বাড়ি ,বাড়ি সংলগ্ন পূজা মণ্ডপ ,দীঘি সহ উদ্যান। বর্তমানে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত একটি পুরাকীর্তি।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক এখানে দুটো ভবন ও পূজা মণ্ডপ সংস্কার সংরক্ষণ পূর্বক একটি পাঠাগার ও একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে স্থাপিত হয়েছে কবির আবক্ষ ভাস্কর্য। রয়েছে মধু উদ্যান। জেক একসঙ্গে মধুপল্লী নামে উল;লেখা করা হয়ে থাকে।
পুরোনো একটি একতলা ভবনে সংরক্ষণ করা হয়েছে মধুসূদন দত্তের বসত বাড়িতে ব্যাবহৃত খাট,টেবিল ,আলনা ,কাঠের সিন্দুক ,লোহার সিন্দুক প্রভৃতি। জাদুঘরের সামনে ১৯৮৪ সালে শিল্পী বিমানেশ চন্দ্র কবির একটি আবক্ষ ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। এছাড়াও মধুপল্লীর সীমানা প্রাচীরের ভিতরে নির্মাণ করা হয়েছে অপেক্ষাগার ,প্রক্ষালনকক্ষ ,প্রশাসনিক ভবন প্রভৃতি।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কৃতিত্ব এখানেই যে ,তিনি যা কিছু রচনা করেছেন তাতেই নতুনত্ত্ব এনেছেন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন।
তখনকার বাংলাসাহিত্যে রচনার শৈলীগত এবং বিষয়ভাবনা গত আড়ষ্ঠতা ছিল,মধুসূদনের তা অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতাগুণে দূরীভূত করেন। ১৮৬০ সালে তিনি গ্রিক পুরান থেকে কাহিনী নিয়ে রচনা করেন পদ্মাবতী নাটক। এই নাটকেই তিনি পরীক্ষামূলক ভাবে ইংরেজি কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যাবহ্যার এটাই প্রথম এবং এর ফলে তিনিঁ বাংলা কাব্যকে ছন্দের বন্দন থেকে মুক্তি দেন।
বাংলা কাব্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যাবহারবে এই সফলতা তাঁকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে এবং এই ছন্দে একই বছর তিনি রচনা করেন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য। পরের বছর ১৮৬১ সালে রামায়ণের কাহিনী নিয়ে একই ছন্দে তিনি রচনা করেন তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি মেঘনাদবধ কাব্য। এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য। আর কোনো রচনা না থাকলেও মধুসূদন এই একটি কাব্য লিখেই আমার হয়ে থাকতে পারতেন। এই কাব্যের মাধ্যমেই তিনি মহাকবির মর্যাদা লাভ করেন এবং নব আবিষ্কৃত অমিত্রাক্ষর ছন্দও বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী
জন্ম : ১৮২৮ সালের ২৫ জানুয়ারী
জন্মস্থান : যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের ধারে সাগরদাঁড়ি গ্রাম
বাংলা সাহিত্যে তিনি যে নামে পরিচিত : বাংলা সাহিত্যে তিনি ” মাধুকবি ” নামে পরিচিত
পিতা : জমিদার রাজনারায়ণ দত্ত যিনি ছিলেন কলকাতার একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল।
মাতা : জাহ্নবী দেবী
বিবাহ : প্রথম স্ত্রী রেবেকা এবং দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটা
শিক্ষা : সাগরদাঁড়ির পাঠশালায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরে সাতবছর বয়সে কলকাতার খিদিরপুর স্কুলে পড়াশোনা করেন।
১৮৩৩ : হিন্দু কলেজ ভর্তি হন। সেখানে তিনি বাংলা ,সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা শেখেন।
১৮৪৪ : বিশপস কলেজ ভর্তি হন
১৮৬২ : ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত গমন এবং গ্রেজ -ইন- এ যোগদান।
১৮৬৬ : গ্রেজ -ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন।
সাহিত্য ও কর্মজীবন : রচিত সাহিত্য সমূহ সাহিত্যে তাঁর অন্যতম অবদান বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তাঁর ১২ টি গ্রন্থ রয়েছে।
১৮৪৮ : ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজ গমন করেন।
১৮৪৮-১৮৫২ : তিনি মাদ্রাজ মেইল অরফ্যান এসাইলাম স্কুলে শিক্ষকতা করেন।
১৮৪৮-১৮৫৬ : মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন।
১৮৪৮-১৮৫৬ : মাদ্রাজে অবস্থানকালে তিনি সাংবাদিক ও কবি হিসেবে পরিচিত লাভ করেন।
১৮৪৮ : TIMOTHY PENPOEM ছন্দনামে প্রথম কাব্যগ্রন্থ THE CAPITIVE LADY প্রকাশিত। EURASION (পরে EASTERN GUARDIAN ) MADRAS CIRCULATOR AND GENERAL CHRONICLE ও HINDU CHRONICLE পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং MADRAS SPECLATOR এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৮৬৩ : প্যারিশ হয়ে ভার্সাই নগরীতে গমন।
১৮৬৫ : সালে পুনরায় ইংল্যান্ড গমন।
১৮৬৭ : দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগ দেন।
১৮৭০ : হাই কোর্টে অনুদান বিভাগে যোগদান করেন।
১৮৭২ : মধুসূদন কিছুদিন পঞ্চকোটের রাজা নীলমনি সিংহ দেও -র ম্যানেজার ছিলেন।উল্লেখযোগ্য অন্যান্য নাটক ও কাব্যগ্রন্থ : পদ্মাবতী নাটক। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য ,মেঘনাদবধ ,বীরঙ্গনা ,কৃষ্ণকুমারী ,ব্রজাঙ্গনা ,হেক্টরবধ প্রভৃতি। তাঁর শেষ রচনা মায়াকানন নাটক।
১৮৬৬ : চতুর্দশপদী কবিতাবলী প্রকাশিত হয়।
মৃত্যু : স্ত্রী হেন্ রিয়েটার মৃত্যুর ৩ দিন পরে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলকাতার জেনারেল হাসপাতালে মহাকবি মৃত্যুবরণ করেন।
কবির মৃত্যু
কৌশিক দে সরকার
কবির মৃত্যু হয়না কভু জেনো,
মরছে যত কবি সাজার দল;
পাঠক নিজেই কবিতা লেখে আজ
বাঁচবে কবি কি-নিয়ে তবে বল!
সম্পাদনায় উড়ল কত বয়স
কবিতা নিয়ে কত রকম খেলা ;
চিতার কাঠ জ্বলছে নাতো ভালো
সাধের কাগজ খাটের নীচে ফেলা।
শব্দগুলো জ্বালিয়ে ছিল আগুন
শাসক শ্রেণি পুড়িয়ে দিল সব
ধীরে ধীরে পুড়ছে কবির মেধা
ভাঙ্গতে প্রথা উঠিয়ে ছিল রব।
উঠতি কবি সঙ্গে ছিল যত
ভাবলো বসে করবে স্মরণিকা ;
হাতের গয়না খুলল সাদাশাড়ি
হবেই সম্পাদক বা প্রকাশিকা।
গড়তে চেয়ে নতুন ধারার লবি
দেওয়ালে এখন তিনি নিজেই ছবি
রক্ত যখন ছুটছে শিরার পথে
মন্ত্রগুপ্ত বানিয়েছিল কবি।
সবাই যখন ছুটতো স্মারক নিতে
মঞ্চে উঠে নিতো শংসাপত্র
বলতো কলম ঝড়িয়ে আগুন শব্দ
সাহিত্য আজ হয়েছে জলছত্র।
গতানুগতিক কবিতাগুলো ফেলে
লিখবে এসো নতুন লেখা কিছু
ওয়ার্কশপে কবিতা শেখান যদি
সোনামণিরা ঘুরত পিছু পিছু।
আজকালতো পাঠক মোটেই নেই
যারা পাঠক তারাও লেখে কিছু
আসল কবি নকল কবির মাঝে
মঞ্চ থেকে দেখতে লাগে নীচু।
জ্বলবে চিতা এমন শত শত
মরবে কবি সম্পাদকের দল
এসব বুঝেও সুধায় কবি হেসে
কবিতাটা কেমন হল – বল।