স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন ক্লাস ফাইভেই, আজ গোটা দুনিয়া চেনে ধর্মপাল গুলাটিকে

আরও পড়ুন

‘অসলি মশলা সচ সচ’ এই জিঙ্গল শোনেননি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। ভারতীয় এমন কোনও পাকশালা নেই, যেখানে তিনি ঠাঁই পাননি। এক কথায় তাঁর ওপরে কোনও ব্র‍্যান্ড নেই। তিনি হলেন মশলার রাজত্বে কয়েক দশক ধরে রাজ করে চলা ‘মহাশিয়াম দি হাট্টি’ বা সংক্ষেপে এম-ডি-এইচ (MDH) মশলা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অধিপতি মহাশয় ধর্মপাল গুলাটি। এক কথায়, তিনি ভারতের একজন কিংবদন্তি। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে তিনি সামলে আসছেন প্রায় ২০০০ কোটি টাকার এই বিশাল বাণিজ্যিক কারবার।

এমডিএইচ-এর অধিপতি মহাশয় ধর্মপাল গুলাটি

এম-ডি-এইচ সংস্থার এই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জনের নেপথ্যে এক বড়সড় সংগ্রামের গল্প রয়েছে। ধর্মপাল গুলাটি জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৩ সালের ২৭ মার্চ, পাকিস্তানের শিয়ালকোটে। ছোটকাল থেকেই দেখে এসেছেন পরিবারের নিত্য সঙ্গী দারিদ্র্যতা। ক্লাস ফাইভ অর্থাৎ মাত্র দশ বছর বয়সে লেখাপড়ার পাট চুকে যায় তাঁর। ধর্মপালের জন্মের আগে ১৯১৯ সালে তাঁর বাবা চুনীলাল একটি ছোট্ট মশলাপাতির দোকান খুলে বসেন। স্কুলের পাট চুকে যাওয়ায় ১০ বছরের ধর্মপাল যোগ দেন বাবার মশলার ব্যবসার কাজে। কিন্তু, মনোযোগ দিয়ে ব্যবসার কাজ করতে না পারায় হতাশ হয়ে পড়েন ধর্মপাল। আসলে বয়সটাও যে একেবারেই কাঁচা! একের পর এক নতুন নতুন ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু, কোনওটাই চালাতে পারেননি দীর্ঘকাল। 

মশলার পর শুরু করেন সাবানের ব্যবসা। তা সফল ভাবে করতে না পারায় ফের খুলে বসলেন কাপড়ের ব্যবসা। তাও চালাতে পারলেন না পুরোদমে। এরপর হয়ে গেলেন পুরোদস্তুর ধান ব্যবসায়ী। তাতেও কয়েকদিন বাদেই মন টিকল না তাঁর। ফিরে এলেন ব্যর্থ হয়ে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর বাবার ব্যবসাকেই এবার দাঁড় করাবেন। কিন্তু, তাতেও এল এক অসুবিধে। মশলার ব্যবসায় যখনই একটু বেশ চড়ার দিকে এগোচ্ছিলেন তিনি, ঠিক সেইসময়েই দেশ ভাগাভাগির মুখে পড়তে হল তাঁদের মতো লাখোলাখো মানুষকে। সাতচল্লিশের দেশভাগের তিন সপ্তাহ পর শত শত মানুষ পাকিস্তানের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে এলেন পাঞ্জাবের অমৃতসরে। সেখানকার শরণার্থী শিবিরে কিছুদিন অতিবাহিত করে তাঁরা চলে এলেন দিল্লিতে।

পাকিস্তান ত্যাগের আগে ধর্মপালের বাবা তাঁর হাতে দেড় হাজার রুপি দিয়েছিলেন। সেই টাকার অর্ধেক ভাগই তিনি খরচ করেন ঘোড়ার টাঙ্গা কেনায়। সেইসময় চরম অর্থকষ্টে এবং দুশিন্তায় দিন কাটে তাঁদের। মাত্র দুই আনা পয়সার বিনিময়ে তিনি কনাট থেকে কারোলবাগে যাত্রী পারাপারের কাজ শুরু করলেন। সারাদিন যাত্রী পাওয়ার জন্য হাঁকিয়ে বেড়াতেন চারদিকে। চাহিদানুসারে লাভ করতে পারছিলেন না। ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েন। ফলত, একাধিক মানুষের কাছে অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। হাঁপিয়ে পড়েন তিনি, না পেরে ঘোড়ার টাঙ্গা বিক্রি করে একটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে ফের মশলাপাতির ব্যবসা শুরু করেন। 

তাঁর বাবার হাত ধরে শেখা অভিনব পদ্ধতিতে মশলা তৈরি করে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এম-ডি-এইচ-এর নাম। এরপর ১৯৫৩ সালে চাঁদনিচকে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় করে তিনি আরেকটি দোকান খুলে বসলেন। ক্রমশ বাড়তে থাকল তাঁর আয়ের পরিমাণ। এর ৬ বছর পর কীর্তিনগরে এক টুকরো জমি কিনলেন তিনি। যাতে বিপুল পরিমাণ  মশলা উৎপাদন করতে পারেন, সেইজন্য একটি কারখানা নির্মাণ করলেন ওই জমিতে। 

বর্তমানে ভারতে মোট ১৫ খানা এম-ডি-এইচ-এর কারখানা রয়েছে। যার পণ্য রফতানি করা হয় প্রায় ১০০ টি দেশে। প্রায় ৬২ রকমের প্রোডাক্ট রয়েছে তাঁদের ব্যবসার ঝুলিতে। এই সংস্থার অধীনে রয়েছে স্কুল এবং হাসপাতালও। এই ব্যবসায় ধর্মপালের একটিই মূলমন্ত্র ছিল। সেটি হল মশলার গুণমানের সঙ্গে কোনওরকম আপোষ না করা। তাঁদের উৎকৃষ্ট মশলার উপাদান আনা হয় কর্ণাটক, রাজস্থান, ইরান, আফগানিস্তান এসব জায়গা থেকে। ভারতের ভোগ্য পণ্যের বাজারে কোনও সিইও (CEO) হিসেবে সবচেয়ে বেশি বেতন পেতেন ধর্মপাল গুলাটি। প্রতিদিন বাজার যাওয়া, কারখানাতে যাওয়া, খুঁটিনাটি সমস্ত কাজ খতিয়ে দেখা, ডিলারদের সঙ্গে আলোচনা সমস্ত কাজ একা করেছেন তিনি। এমনকি ছুটি নিতেন না রবিবারেও। ব্যবসায় তাঁর এই অমূল্য অবদানের জন্য তিনি ভূষিত হয়েছে ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানে।

তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি, মনের জোর নতুন করে দাঁড় করিয়েছে এই ব্যবসাকে। স্ত্রী, এক পুত্র এবং ছয় কন্যার বিশাল সংসারের একমাত্র ছাতা ছিলেন তিনি। ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৯৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। 

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close