‘জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার’-এর উদাহরণ ব্যাখ্যা করেছিলেন লেখক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়
কলকাতার একটি দৈনিক খবরের কাগজের সংবাদিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ওরফে ”বনফুল” কে একদিন প্রশ্ন করেছিলেন – ‘অনেক পুরস্কার তো পেয়েছেন , কোনটিকে জীবনের সেরা পুরস্কার বলে মনে করেন ?
”বনফুল” কিঞ্চিৎ ভেবে বললেন -‘সে অর্থে আমার জীবনের সেরা পুরস্কার কিন্তু অন্যরকম !! ‘
—–‘একটু খুলে যদি বলেন !’
—–‘দেখুন ভাগলপুর রেলস্টেশনের দিকে একরকম দৌড়েই যাচ্ছি সঙ্গে কুলি রয়েছে কলকাতা যাবার বিশেষ তাগিদে। রেল স্টেশনে পৌঁছনোর আগেই দেখি- ট্রেন ছেড়ে দিল !!!’
পরবর্তী রেলগাড়ি পরদিন ! কি করবো ভেবে পাচ্ছি না , এদিকে না গেলেই নয় ! এইরকম অবস্থায় হাঁপাতে হাঁপাতে কোনোরকমে এসে স্টেশনের বেঞ্চে বসে পড়লাম। ভাবছি কি করা যায় !
কিছুক্ষণ পরেই দেখি যে প্লাটফর্ম থেকে ট্রেনটি (কলকাতা যাবার উদ্দেশে ) ছেড়ে চলে গেল এই মাত্র ওই প্ল্যাটফর্মেই পিছনদিক থেকে একটা ট্রেন ব্যাক করে আসছে। আর পাঁচ জন যাত্রী এবং রেল দফতরর কর্মীদের মতো আমিও হতবাক (!) ট্রেন দাড়ালো ——
অনেকেই হৈ চৈ করছেন। এক ভদ্রলোক আমার সামনে এসে বললেন —-” স্যার আমি আপনাকে জানি ডাক্তার হিসেবে তো বটেই ,তার চাইতেও বেশি করে জানি – কারণ , আপনার সবকটি লেখাই আমার পড়া। ”
——”আপনাকে দৌড়তে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম – কলকাতা যাবার গাড়ি ধরতে আসছেন। আমিই স্যার ওই রেলগাড়িটির চালক। তাই আপনার জন্যই গাড়ি ব্যাক করে আপনাকে নিতে এলাম। চলুন স্যার তাড়াতাড়ি চড়ুন !!! ”
——-” ” একজন ট্রেন চালক রেল ব্যাক করে আমাকে রেলগাড়িতে তুলে তারপর সামনের দিকে চলতে শুরু করে। ” ”
এর চাইতে বড় পুরস্কার আর কি হতে পারে !
লৌহমানব কৃতি বাঙালিকে মনে আছে কারও ? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বতন
নাম কি ছিল (!)
গোবরডাঙার নাম শুনেছেন ?
কি করেই বা শুনবেন? এখানে না আছে কোনও টুরিস্ট স্পট, নেই কোনও ধর্মীয় অথবা দর্শণীয় স্থান । অথচ ২৪ পরগণার এই অখ্যাত গন্ডগ্রামে এমন একজন বঙ্গসন্তান জন্মেছিলেন যিনি বদলে দিয়েছিলেন দেশের শিল্প মানচিত্রটাই ।
১৮৫৫ সালে জন্ম এই মানুষটি শৈশবাবস্থা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী । মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করে জলপানি পেয়ে পড়তে গেলেন কৃষ্ণনগর কলেজে । দু’বছর পর মেধা দেখে অধ্যাপকরাই পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্সে । বসলেন
গিলক্রিস্ট স্কলারশিপ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের পরীক্ষায়, প্রথম হয়ে কলকাতাকে বাই বাই করে চলে এলেন কেমব্রিজে ।
সালটা ১৮৭৪, আর এখানে আসার পর বন্ধুত্ব হ’ল রবিঠাকুরের সঙ্গে । মনে রাখবেন তিনিই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞান স্নাতক ।
এর পর ভর্তি হলেন রয়েল স্কুল অফ মাইনস্ (Royal School of Mines) এ, বিষয় ভূতত্ত্ব ও ফসিল (palaeontology.) ।
সাহেব খোকাদের পেছনে ফেলে সেখানেও তিনি শেষ পরীক্ষায় প্রথম । কিন্ত আর পাঁচজন ভারতীয়র মতো মেম বিয়ে করে সেখানেই স্থিতু না হয়ে চাইলেন দেশে ফিরে আসতে । ইংল্যান্ডে থাকতেই তাঁর কানে এসেছিল ভারতে নতুন শিল্প গড়ে ওঠার পরিবেশ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে । লন্ডনে সেক্রেটারি অফ স্টেট ( secretary of state) এর অফিসে সরকারি শিক্ষা দফতর অথবা জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ( Geological Survey of India)তে (GSI) চাকরির জন্য দরখাস্ত করলেন । দুটোর কোনটিতেই বৃটিশ সরকার তাকে চাকরি দিল না ।
বাধ্য হয়ে খরচ চালানোর জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন । এর মাধ্যমেই আলাপ হলো দাদাভাই নওরোজী ও আনন্দমোহন বসুর সঙ্গে, তৈরি করলেন ইন্ডিয়া সোসাইটি নামে এক সোসিও পলিটিক্যাল ( Socio Political) সংস্থা । এবার তার বক্তৃতাতে ভারতীয়দের প্রতি বৃটেনের বঞ্চনার কথা আসতে শুরু করল, বিপদ বুঝে সরকার ব্রিটিশ সরকার জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট ( GSI)- তে (Asst. superintendent) পদে নিয়োগ করে ভারতে পাঠিয়ে দিলো । সালটা ছিল ১৮৮০, তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি এই উচ্চ পদে সরাসরি আসীন হয়েছিলেন । ভাগ্যিস হয়েছিলেন আর তাই দেশের শিল্পক্ষেত্রে সূচনা হ’ল এক নতুন মাইলস্টোন !
কলকাতার হেড অফিসে ফ্যানের তলায় বসে কাজ করার পাত্র ছিলেন না এই বঙ্গসন্তান । পরবর্তী পাঁচ বছরে মধ্যপ্রদেশের দল্লি রাজহরায় মাটির নীচে খুঁজে বের করলেন বিশাল লৌহ আকরিকের খনি । ১৮৯০ সালে দার্জিলিং অঞ্চলে আবিষ্কার করেন ভূগর্ভস্থ কয়লার সঞ্চয় । অসমের ডিগবয় ও নাহারকাটিয়ায় পেট্রোলিয়াম খনিও এই বাঙালী মানুষটারই আবিষ্কার । তৈরি করেন দেশীয় পদ্ধতিতে প্রথম সাবান তৈরির কারখানা ।
কিন্ত যে আবিষ্কারের জন্য তিনি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন, তা ঘটলো ,১৯০৩ সালে, সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ।
তৎকালীন ময়ুরভঞ্জ রাজ্যের বাঙালি দিওয়ান মোহিনীমোহন ধর তার কাছে খনিজ পদার্থ পাওয়ার সম্ভাবনা জরিপ করার প্রস্তাব নিয়ে আসেন । খাতায় কলমে সম্ভাবনার উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে ওই রাজ্যে কোনদিন জরিপ হয়নি । জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ মানুষটি ওই বয়সেও রাজি হয়ে যান এবং কাজ শুরু করেন । তিনমাসের মধ্যে ওখানকার গরুমহিষানী পাহাড়ের ঢালে ভূগর্ভস্থ লৌহ আকরিকের এক বিশাল সঞ্চয় খুঁজে পান । নিজের নোটবুকে লিখেছিলেন,” আমি জানিনা এখানে সঞ্চয়ের মোট পরিমাণটা কতো, কিন্ত আমার বিশ্বাস এটা একরকম অফুরন্ত এবং বেশ কয়েকটা আধুনিক ফার্নেসকে এই খনি অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবিরাম যোগান দিতে পারবে !”
তার অনুমান ভুল ছিল না, আজও ওড়িশার এই খনি থেকে দেশের সবচেয়ে বেশি আকরিক লোহা উত্তোলন হয় ।
বিগত ১৯০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আকরিকের এই সঞ্চয়ের কথা জানিয়ে ভূতাত্বিক মানুষটি চিঠি লিখলেন দেশীয় শিল্পপতি জামশেদজী টাটাকে । মূলত তারই আগ্রহে ওই খনি অঞ্চলের কাছাকাছি সাকচিতে টাটা-রা স্থাপন করেছিল দেশের প্রথম লৌহ ইস্পাত কারখানা ।
বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষটি বুঝেছিলেন- শিল্পের উন্নতির জন্য চাই কারিগরী শিক্ষা আর তাই স্থাপন করেছিলেন বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, (Bengal Technical Institute) ,যা পরে নাম বদলে হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ।
প্রমথনাথ বসু ১৮৫৫ সালের ১২ মে উত্তর ২৪ পরগণার গোবরডাঙা গ্রামে জন্মেছিলেন জীবাশ্ম বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য তিনি পরিচিতি লাভ করেন। কাজের চাপে অবশ্য সামাজিক কর্তব্য করতে ভুলে যাননি, বিয়ে করেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও সিভিলিয়ান রমেশচন্দ্র দত্তের কন্যা কমলাকে ।
পুত্র মধু কিন্ত বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেননি ।বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র বিয়ে করেন কেশব সেনের নাতনী সাধনাকে । মধু সাধনা জুটির বহু হিট সিনেমা আজও বাঙালির স্মৃতিতে উজ্জ্বল ।
চিনতে পারলেন ওই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে ? আমরা না চিনলেও টাটা কোম্পানি বা জামশেদপুরবাসী ভোলেনি তাঁকে। প্রতি বছর ধুমধাম করে পালিত হয় ওই বাঙালি কৃতির জন্মদিন। তাঁর আবক্ষ মূর্তিতে মালা দিতে আসেন খোদ রতন টাটা, এসেছেন নেহরুজীও ।
দেশের অন্যতম বিজ্ঞানী এই বঙ্গসন্তানটি হলেন প্রমথনাথ বসু।