অতি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনের গল্প নিয়ে তৈরি ছবি ‘ঝরা পালক‘। ঝরা পালক মূলত জীবনানন্দ দাশের লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ। যা প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে মোট ৩৫টি কবিতা তিনি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ‘নির্জনতম কবি’ হিসেবে পরিচিত জীবনানন্দ দাশ। তাঁকে নিয়ে এর আগে বড়পর্দায় সেরকম কোনও কাজ হয়নি। বলতে গেলে এই প্রথম। এই ছবি পরিচালনা করেছেন সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়। ছবিতে কবির দাম্পত্যের কাহিনী চিত্রায়িত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ছবিতে জীবনানন্দ দাশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা ব্রাত্য বসু। কবিপত্নী লাবণ্যপ্রভা দাশের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান। ইতিমধ্যেই ছবিটি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে। কবির বিভিন্ন বয়সের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্রাত্য বসু এবং রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়া কবি সজনীকান্ত দাসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার, কৌশিক সেন অভিনয় করেছেন কবি বুদ্ধদেব বসুর চরিত্রে, এবং কাজী নজরুল ইসলামের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুপ্রিয় দত্ত। কবিতায় আরও কবিদের মধ্যে রয়েছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুধীন্দ্রনাথ দত্তরা।
অভিনেত্রী জয়া আহসান ঝরা পালক ছবি প্রসঙ্গে বলেন, “আমার চরিত্রের ভেতরেও জীবনানন্দ দাশের অন্যান্য যে চরিত্রগুলি রয়েছে, তারও একটা ছায়া আছে৷ আরেকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমার মনে হয়, জীবনানন্দ দাশ এমন একজন কবি যিনি কিনা মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বক্ষণই কবিতার মধ্যেই ডুবে থাকতেন, তার চরিত্র ফুটিয়ে তোলা মোটেই মুখের কথা নয়। সারাটা জীবনে খুব কম শান্তি পেয়েছেন তিনি। ঢের যন্ত্রণায় ছিল তাঁর। অতএব, তাঁর স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করাটা আমার কাছে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “লাবণ্যপ্রভা অর্থাৎ যে চরিত্রটি আমি করেছি, তিনি হলেন কবির স্ত্রী। মা ছাড়া কবির জীবনে একমাত্র নারী ছিলেন লাবণ্যই। পাশাপাশি কবির জীবনের বড় অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর স্ত্রী। ছবিতে আপনারা সেই আভাস পাবেন।” ছবিটি শেষ হবে জয়া আহসানের বিখ্যাত সংলাপ- “বাংলা সাহিত্যকে তাহলে তোমার দাদা অনেক কিছুই দিয়ে গেলেন, কিন্তু আমার জন্যে কি রেখে গেলেন?” দিয়ে। স্বামী জীবনানন্দের মৃত্যুর পর স্ত্রীর একা হয়ে যাওয়া, তাঁকে চিরকালীন না পাওয়ার ক্ষোভ, জীবন যন্ত্রণার অসহায়তা সবকিছুই খুব সুন্দরভাবে এই সংলাপের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন জয়া। ছবিতে লাবণ্য চরিত্রটি কখনও সংসার জ্ঞানহীন কবির আটপৌরে স্ত্রী, কখনও বারবনিতা, কখনও আবার দেবী রূপে আবির্ভূত হয়েছেন পর্দায়।
ছবিতে মূলত কবির দাম্পত্য জীবনের ধূসর কাহিনী চিত্রায়িত হয়েছে। রয়েছে তাঁদের সাংসারিক টানাপোড়েনের গল্প। এর পাশাপাশি রয়েছে, সে আমলের সামাজিক প্রেক্ষাপট, তৎকালীন কবি মহলে জীবনানন্দ দাশের অবস্থান এবং কবির জীবনে পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব। জীবনানন্দ দাশের ‘মাল্যবান‘ উপন্যাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নির্মিত হয়েছে ‘ঝরা পালক’। গত ২০১৭ সালে ছবির শ্যুটিংয়ের কাজ আরম্ভ হয়। মাঝে করোনা মহামারির জেরে পিছিয়ে যায় কাজ। নাহলে বহু আগেই এই ছবি মুক্তির কথা ছিল।
উল্লেখ্য, এই ছবি প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশের চরিত্রে অভিনয় নিয়ে ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, “কবির চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক শাহাদুজ্জামানের ‘একজন কমলালেবু’ উপন্যাসটি বিশেষভাবে আমাকে সাহায্য করেছে। কবির দাম্পত্য জীবনে যে নির্জনতা ছিল, সেটা পর্দায় আমার আর জয়ার রসায়নে প্রতিফলিত হয়েছে।” কবি যখন ‘রূপসী বাংলা‘ কবিতা রচনা করছেন, সেসময়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাহুল।
সূত্রের খবর, ছবির শ্যুটিং হয়েছে মূলত কলকাতাতেই। কিছু জায়গার শ্যুট হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে, তেহট্ট থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সেখানে জীবনানন্দের রূপসী বাংলার যে চিত্রকল্প, তা ধরা পড়েছে। ছবিতে ধানসিঁড়ি নদীর বদলে দেখানো হয়েছে জলঙ্গী নদী। জলঙ্গীও কবির রচনায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে।
কবি জয় গোস্বামী এই ছবিটি মোট ৩ বার দেখেছেন। ভীষণভাবে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “এই ছবি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত। আমি প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখতে পারিনি ছবিটি। পরিচালক নিজেই আমায় এই ছবিটি পাঠিয়েছিলেন দেখবার জন্য। আমি যে চলচ্চিত্র বেশ বুঝি তেমনটা নয়। তবু বলছি, এই ছবির মাধ্যমে জীবনানন্দের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত হল। তাঁর লেখা উপন্যাস নিয়ে এর আগে দুটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে কলকাতায়। কিন্তু, চলচ্চিত্রে এই প্রথম তাঁর জীবনীকে তুলে ধরা হল। এই ছবিতে ট্রামের ব্যবহার আমায় খুব ধাক্কা দিয়েছে।”
উল্লেখ্য, ঝরা পালক প্রসঙ্গে পরিচালক সায়ন্তন মুখোপাধ্যায় জানান, “একটা গ্যাংস্টারের জীবনী বানাতে গেলে তিনি কবে জন্মেছিলেন, কার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল, কাকে কাকে মেরেছিলেন এসব বললেই হয়ে যায়। কিন্তু, একজন কবির জীবনে সেই অর্থে কোনও ড্রামা থাকে না। তবে হ্যাঁ, জীবনানন্দের জীবনে যথেষ্টই ড্রামা ছিল, তাঁর বৈবাহিক জীবন এবং প্রেমজীবন ঘিরে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কবির জীবনী এবং কবির পুরো শিল্পকর্ম এই দুটোকে কিভাবে একত্রে করা যায়। সৃষ্টি তো তাঁর জীবনের চেয়েও বড়, বিশেষ করে তাঁর মতো একজন কবির কাছে।”
কবিপত্নী লাবণ্যর চরিত্রে জয়াকে কেন বেছে নিলেন এ প্রসঙ্গে সায়ন্তন জানান, “আমি প্রথম যখন লাবণ্য চরিত্রের ভিজুয়ালাইজেশন করি, তখন জয়া ছাড়া আর কারও মুখই আমার সামনে আসেনি। এইরকম পানপাতার মতো অদ্ভুত একটা বাঙালি মুখ, যেটা একইসঙ্গে বনলতা সেন, সুরঞ্জনা এবং লাবণ্যকে ফুটিয়ে তুলতে পারে। জয়া নিজেও এই চরিত্রটি করতে গিয়ে ভীষণ ঢুকে গিয়েছিলেন চরিত্রের মধ্যে। শুধু অভিনয় দিয়েই নয়, আমাকে বেশ কিছু বই দিয়েও উনি সাহায্য করেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “ঝরা পালক নিয়ে সবচেয়ে বেশি আত্নবিশ্বাসী ছিলেন ব্রাত্যদা এবং জয়া। এই ছবিতে ব্রাত্যদা যেমন অভিনয় করেছেন, তা আগামীতে কোথাও করতে পারবেন কিনা তা জানিনা। পাশাপাশি জয়াও এ ছবি নিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে কিছু কাজ করব এ কথা আমি ছোটবেলাতেই ভেবে রেখেছিলাম। বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছি। তবে, ছবি করার কথা মাথায় আসে অনেক পরে। ছবিতে আপনারা তিনটে সময়ের সংযোগ দেখতে পাবেন। একটা রিল টাইম, একটা রিয়্যাল টাইম, এবং তার সঙ্গে রিসেন্ট টাইম।”
পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় এই ছবির বিশেষ প্রশংসা করেছেন। ছবিকে ‘এমিনেন্ট পিস অফ ওয়ার্ক’ বলে বর্ণনা করেছেন কবি জয় গোস্বামী। পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকেও এই ছবি দেখানো হয়েছিল, তিনিও বেশ গুণগান করেন এই ছবির। ছবিটি বাংলাদেশেও রিলিজ করবার কথা ভাবা হয়েছে। এ একেবারেই এক অন্য ধারার ছবি৷ জীবনানন্দ ১৯ শতকে যেমন অপরিহার্য ছিলেন, আজও তাই রয়ে গেছেন।