বিনামূল্যে পেট ভরা খাবার মেলে ‘ভালো কাজের হোটেল’-এ

সারাদিনে যে কোনও ভালো কাজ করলেই এই হোটেলে মিলবে পেট ভর্তি খাবার। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশের 'ভালো কাজের হোটেল' প্রতিদিন এই মানবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

“এখানে খেতে টাকা লাগবে না, যে কোনও একটি ভালো কাজ করলেই হবে”। এটাই তাঁদের মূল কথা। প্রতিদিন কিছু ক্ষুধার্ত মানুষ আসছেন, একটা ভালো কাজের বিনিময়ে খেয়ে যাচ্ছেন পেট ভরে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কমলাপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে গড়ে উঠেছে এক অভিনব হোটেল। তার নাম ” ভালো কাজের হোটেল”

ভালো কাজের হোটেল

তবে, এই হোটেল কিন্তু আর পাঁচটা হোটেলের মতো নয়। এই হোটেল খোলা আকাশের নীচে, তার কোনও দেওয়াল নেই, নেই কোনও টেবিল চেয়ার, নেই ক্যাশবাক্স, খাওয়ার জন্য বেয়ারাদের হাঁকডাকেরও কোনও ব্যাপার নেই। খোলা আকাশের নীচে ফুটপাতে বসেই পেট পুরে খেয়ে যান হোটেলে আসা অতিথিরা। কতগুলি তরুণ ছেলে, পরনে সবুজ রঙের টিশার্ট আর তাতে লাল রঙ দিয়ে লেখা রয়েছে ‘ভালো কাজের হোটেল’। তাঁরাই হোটেলে আসা অতিথিদের নিয়মিত খাবার পরিবেশন করে চলেছে।

সংগঠনের তরুণেরা

এখানে যাঁরা খেতে আসেন, তাঁদের কেবল তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। ‘আপনার নাম কি?’ ‘বয়স কত?’ আর, ‘আজ আপনি কি ভালো কাজ করেছেন?’ এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর ক্লিপবোর্ডে আঁটা একটি কাগজে লিখে রাখছে ওই তরুণ বয়সী ছেলেরা। কাজটি যদি আক্ষরিক অর্থেই ভালো হয় এবং সৎ উদ্দেশ্যে করা হয় তাহলেই সকলের হাতে তুলে দেওয়া হয় খাবারের প্যাকেট।

ভালো কাজ বলতে, তা রাস্তায় কোনও অন্ধ ব্যক্তিকে হাত ধরে পার করে দেওয়া হতে পারে, রাস্তা থেকে পাথরের টুকরো, কাঁচ, পেরেক ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা হতে পারে, রিকশার ভাড়া না নিয়ে অসহায় ব্যক্তিকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হতে পারে, কাউকে দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচানো হতে পারে, কোনও মুমূর্ষু রোগীকে সেবা করা হতে পারে, বা কোনও রোগীকে রক্তদান করা হতে পারে, রাস্তার কুকুরদের খাবার দেওয়াও হতে পারে।

মূলত এই হোটেলের উদ্দেশ্য হল, ভালো এবং সৎ কাজের চর্চায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করা এবং সমাজে ক্ষুধার যন্ত্রণা কমিয়ে, ক্ষুধা মুক্ত, অপরাধমুক্ত এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। ক্ষুধার জ্বালা থেকেই মূলত খারাপ কাজগুলির উৎপত্তি হয় বিশ্ব জুড়ে। তাই, এই জ্বালা কমিয়ে অসহায় মানুষগুলিকে একটি ভালো কাজে উৎসাহিত করার জন্যই এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। হোটেলের উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, “আমরা মনে করি একটি ভালো কাজ করবার সদিচ্ছা দশটি খারাপ কাজ করা থেকে আপনাকে বিরত রাখতে পারে।”

তাঁরা জানায়, “ভালো কাজের জন্য তো খাবার আছেই, যদি আপনি আজ কোনও ভালো কাজ নাও করে থাকেন তাও আপনাকে খালি মুখে ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। সেক্ষেত্রে শর্ত থাকে একটাই, পরের দিন আপনাকে অবশ্যই দুটো ভালো কাজ করতে হবে।” উল্লেখ্য, রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তাদের খাবারের তালিকায় থাকে ডিম-খিচুড়ি। শুক্র এবং শনিবারের খাদ্য তালিকায় থাকে বিরিয়ানি, পোলাও এবং মুরগি তেহারি। আর বছরের বিশেষ দিনগুলিতে থাকে বিশেষ খাবারের আয়োজন।

ভালো কাজের হোটেলের আর্থিক উৎস সম্পর্কে জানা যায়, তাঁরা এই কর্মকাণ্ডের জন্য কোনওরকম ডোনেশন নেন না। তাঁরা ‘ডেইলি টেন’ নামক একটি বিশেষ তহবিলের মাধ্যমে এই মানবিক কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এই তহবিলে রোজ যাঁরা ১০টাকা করে জমা দেন তাঁরাই এর বিশেষ সদস্য। বর্তমানে এই ডেইলি টেন-এর মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৩৫০ জন। তবে, তাঁদের দেওয়া অর্থে গোটা মাসের খাবারের আয়োজন করা যায় না। সেক্ষেত্রে দলের সংগঠক এবং স্বেচ্ছাসেবকরা এগিয়ে আসেন।

আবার সংগঠনের অনেক সদস্যই আছেন যাঁরা ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করে থাকেন। এই সংগঠনের নিজস্ব একটি ব্যাটারী চালিত গাড়ি আছে। নির্দিষ্ট স্থানে অতিথিদের জন্য রান্নাবান্না সম্পূর্ণ হওয়ার পরে ওই গাড়িতে করেই খাবারের প্যাকেটগুলি নিয়ে যাওয়া হয় ভালো কাজের হোটেলে। সংগঠনের সদস্যরা জানান, “আমাদের কাছে এমন অনেক প্রশ্ন আসে, আপনারা কি শুধুই খাওয়ান? আর কিছু করেন না? বর্তমানে আমরা সেই কথা মাথায় রেখে অসহায় মানুষদের খাওয়ানোর পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষা এবং দরিদ্র অসুস্থ শিশুদের জন্য চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেছি।”

ভালো কাজের হোটেলের তরুণ সদস্যরা

কবে থেকে শুরু হল এই ‘ভালো কাজের হোটেল’-এর পথ চলা? শুরু হয় ২০০৯ সালে। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কয়েকজন তরুণের মনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল এক ব্যক্তির অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর গল্প। তাঁদেরই মধ্যে একজন আরিফুর রহমান। তাঁর কথায়, “আমরা ওইসময় এক অসহায় বাবার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। তাঁর মেয়ের চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল। তা জোগাড় করতে তিনি পথে পথে ঘুরছিলেন। তাঁকেই প্রথম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই আমরা।”

এরপর থেকেই সমাজের নানা ভালো কাজে নিজেদের যুক্ত করে ফেলেন ওই তরুণেরা। তাঁদের সামাজিক কাজগুলির বিস্তৃতি ঘটাতে এবং সাংগঠনিক একটি রূপ দেওয়ার পরিকল্পনার কথা ভেবে ২০১২ সালে তাঁরা ফেসবুকে ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’ (Youth for Bangladesh) নামক একটি পেজ চালু করেন। শুরু হয় তাঁদের দেশব্যাপী কার্যক্রম। দেশের নানা প্রান্তে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে ছুটে যেতেন ওই তরুণেরা।

আর ভালো কাজের হোটেলের ভাবনা তাঁদের মাথায় আসে হুমায়ুন আহমেদের একটি নাটক দেখে। আরিফুরের কথায়, “ছোটবেলায় ‘সবুজ ছায়া’ নামে একটি নাটক দেখেছিলাম। হুমায়ুন আহমেদের নাটক। তাতে অভিনয় করেছিলেন জাহিদ হাসান। তাতে প্রতিদিন একটা ভালো কাজ বলত। এই বিষয়টা আমায় খুব নাড়া দিয়েছিল। প্রতিদিনের একটি ভালো কাজের যোগফল আমাদের জীবনটা কিন্তু পালটে দিতে পারে।”

ভালো কাজের হোটেলের খাবার বাক্স

ঢাকা শহরের মোট ৫টি জায়গায় নিয়মিত খাবার বিতরণ করে ভালো কাজের হোটেল। তার মধ্যে কমলাপুর বাসস্ট্যান্ড, সদরঘাট, ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবর, বনানী কবরস্থান এবং বিমানবন্দর রেলস্টেশন। এই হোটেলের এক স্বেচ্ছাসেবক জানান, “সারাদিনের শেষে যখন আমাদের দেওয়া খাবার তৃপ্তি সহকারে খেয়ে অসহায় মানুষগুলির মুখে হাসি দেখি, তখন মনটা খুশিতে ভরে যায়। আসুন, প্রতিদিন একটি হলেও ভালো কাজ করি আমরা।”

সমাজের ভাবমূর্তি পালটে দিয়েছে এই ‘ভালো কাজের হোটেল’। এই মহান উদ্যোগকে কুর্নিশ জানিয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্টজনেরা।

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close