ভারতের পক্ষীমানব সালিম আলি, কেমন ছিল তাঁর পক্ষী গবেষণা

পাখিদের সম্পর্কে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যারা গবেষণা করেন, ভারতীয়দের মধ্যে এ বিষয়ে ভারতের পক্ষীমানব ওরফে সালিম আলি একজন অন্যতম পক্ষীবিদ। ভারতের বিচিত্র সব পাখিদের বিবরণ নিয়ে পাহাড়প্রমাণ বই রচনা করেছেন তিনি, যা আদতে বিস্ময়কর।

আরও পড়ুন

মনে প্রাণে পাখিদের আজীবন ভালোবেসেছেন তিনি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত পাখিদের জীবন, ধরণ-ধারণ, চলাফেরা সমস্তটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন এই মানুষটা। পাখিদের নিয়ে তাঁর ছানবিন অবশ্য শুরু হয়েছিল একেবারে হাফপ্যান্টের বয়স থেকে। বাহারি সব পাখি, কারও হয়তো গায়ে রঙিন ছোপ, কারও লেজ বড়ো, কারও ঠোঁটটা বাঁকানো, কারও আবার চোখটা যেন কাজল পরানো এইসবই দেখে বেড়াতেন তিনি সারাদিন। আসলে, এই নিয়েই থাকতে ভালোবাসতেন। পাখিদের বিষয়ে তাঁর অগাধ জ্ঞান এবং অবদানের জন্য তিনি ‘ভারতের পক্ষীমানব বা বার্ডম্যান‘ হিসেবে পরিচিত।

ভারতের বার্ডম্যান সালিম আলি

সালিম মইজুদ্দীন আব্দুল আলি ওরফে সালিম আলির আজ ৩৫ তম প্রয়াণ বার্ষিকী। তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অফ আ স্প্যারো‘-তে তিনি লিখেছিলেন, “অস্থিতপঞ্চক সভ্যতার দ্রুতবেগে এই যান্ত্রিক যুগের কোলাহলময় ডামাডোল থেকে আমার একমাত্র মুক্তির রাস্তা হল পাখি দেখা।” উল্লেখ্য, তাঁর এই বিশেষ বইটি বাংলায় ‘চড়াই উৎরাই’ নামে প্রকাশিত হয়।

সালিম আলির জন্ম হয় ১৮৯৬ সালের ১২ নভেম্বর মুম্বাই শহরে। সুলাইমানি বোহরা গোত্রের এক মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন নয় ভাইবোন। খুব ছোট বয়সেই বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন সালিম আলি। অনাথ ভাগ্নে ভাগ্নীদের লালন পালনের দায়িত্ব নিলেন মামা আমিরুদ্দীন তায়েবজী এবং মামী হামিদা বেগম। তাঁর মামা তৎকালীন সমাজে বেশ উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন, ভালো শিকার জানতেন এবং আরেক মামা আব্বাস তায়েবজী ছিলেন প্রখ্যাত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী।

সালিমের যখন ৯ বছর বয়স তখন মামা আমিরুদ্দীন তাঁকে একটা খেলনা এয়ারগান উপহার দিয়েছিলেন। তা নিয়েই সারাদিন মেতে থাকতেন ছোট্ট সালিম। একদিন ওই এয়ারগান দিয়ে একটি চড়াই পাখি শিকার করেন সালিম। চড়াইটি যে অন্য জাতের পরে শনাক্ত করা হয়। ওই বিশেষ প্রজাতির চড়াইটির জন্যই বোম্বের ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটির তৎকালীন সচিব ওয়াল্টার স্যামুয়েল মিলার্ডের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়।

জেনানা বাইবেল মেডিক্যাল মিশন হাই স্কুল থেকে সালিম আলি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কলেজের পড়া শেষ না হতেই সালিমকে চলে যেতে হয় বার্মার তেভয়ে। সেখানে পারিবারিক ব্যবসার দেখাশোনার কাজ করেন তিনি। দীর্ঘ ৭ বছর সেখানে কাটিয়ে ফের ভারতে ফিরে আসেন সালিম। ফিরে এসে দেবরের কলেজ অফ কমার্সে তিনি বাণিজ্যিক আইন এবং হিসাববিদ্যায় ভর্তি হন। এরমধ্যেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ফাদার এথেলবার্ট ব্লাটার-এর নজরে আসেন তিনি। এথেলবার্ট জানতেন সালিমের জীববিজ্ঞানের প্রতি এক অন্য ভালোলাগা আছে। তিনি সালিমকে জীববিদ্যা নিয়ে পড়ার জন্য বলেন। রাজি হয়ে যান সালিম। সকালে বাণিজ্যিক বিজ্ঞান আর বিকেলে জীববিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে লাগলেন তিনি।

১৯১৮ সালে তাহমিনা আলির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সালিম। সবুজের সমারোহ আর পাখিদের ছাড়া সালিমের জীবনের আরেকটি বিশেষ ভালোবাসার জিনিস হল মোটরসাইকেল। পূর্বে বার্মা থেকে পশ্চিমে আফগানিস্তান, উত্তরে তিব্বতের মালভূমি কৈলাস মানস সরোবর থেকে দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা কোথায় না গিয়েছেন তিনি। পাখিদের জীবন নিয়ে পড়াশোনার জন্য ১৯২৯ সালে তিনি জার্মানি পাড়ি দেন। সেখানে গিয়ে তিনি জানলেন বাবুই পাখিদের বাসা তৈরির অদ্ভুত রীতি সম্পর্কে।

পড়াশোনার ফাঁকে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন আর নতুন নতুন পাখিদের খুঁজে বেড়াতেন তিনি। সেসব পাখিদের সম্পর্কে নিয়মিত একটি ডায়েরিতে তিনি লিখে রাখতেন। সেই পাখিদের বিবরণ নিয়ে এবং তাদের ছবি সংগ্রহ করে পরে একাধিক বই লিখেছেন সালিম। ১৯৪১ সালে তাঁর লেখা ‘বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস‘ বইটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৫৮ সালে তাঁকে ভারত সরকার পদ্মভূষণে সম্মানিত করে। ওই বছরই তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে মনোনীত করা হয়। ১৯৭৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাম পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন সালিম।

১৯৭১ সালে পরিবেশ বিষয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পল গেটি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন তিনি। ওই পুরস্কারের প্রায় ৫০ হাজার ডলার তিনি মুম্বাই ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে দান করেন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পক্ষীবিজ্ঞান সম্পর্কে পড়াকালীন তাঁর আলাপ হয় একাধিক দিকপাল জীববিজ্ঞানীদের সঙ্গে। হেলিগোল্যান্ড দ্বীপে পাখিদের প্রজনন নিয়ে কাজ করতে যান সালিম। ১৯৬৬-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভুটানে ৬টি সংগ্রহ অভিযান করেছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালে রাজস্থানের ভরতপুরের কেওলাদেও ঘানার অরণ্যে তিনি প্রথম সাইবেরিয়ান সারস দেখলেন। ১৯৫০ সালে সুইডেনে আন্তর্জাতিক পক্ষীতাত্ত্বিক কংগ্রেসে তিনি একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

১৯২৬ সালে মুম্বাইয়ের প্রিন্স অফ ওয়েলস মিউজিয়ামে গাইড লেকচারার পদে চাকরি পান সালিম আলি। তাঁর বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস বইটি জওহরলাল নেহেরু কারাবাসে থাকাকালীন পড়েন এবং মুগ্ধ হন। ওই সময়েই ভারতের অন্য জেলে বন্দী থাকা তাঁর কন্যাকে সালিম আলির বইটি উপহার দেন। উল্লেখ্য, সালিম আলির নামানুসারে গোয়ার বার্ড স্যাংচুয়ারি, কেরালার থাট্টেকাড বার্ড স্যাংচুয়ারি, পুদুচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স বিভাগের নামকরণ করা হয়। ২০১৬ সালে ভারতে আবিষ্কৃত হয় হিমালয়ান ফরেস্ট থ্রাশ। তার বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে ‘জুথেরা সালিম আলি’।

একটা পাখির চালচলন খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার কথা ভাবা যেতে পারে, কিন্তু একটা গোটা দেশের অসংখ্য বিচিত্র পাখিদের জীবনযাপন জরিপ করা সত্যিই অভাবনীয়। সালিম আলি তাঁর ৯১ বছরের দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে দিলেন পাখিদের নিয়েই। তাদের বাহারি রঙ, বিচিত্র আকার আকৃতি দেখবার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রকৃতির কোলেই কাটাতেন তিনি। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখবার জন্য সবরকম পাখির ভূমিকাই প্রকৃতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সালিম আলি তাঁর গবেষণার প্রত্যেক স্তরে এই কথাই বলে গিয়েছেন একাধিকবার।

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close