সাগর এবং বিনোদের ‘ওয়াও মোমো’ পাড়ি দেবে বিদেশেও

মাত্র ৩০ হাজার টাকায় 'ওয়াও মোমো'-র ব্যবসা শুরু করেছিলেন সাগর দারিয়ানি এবং বিনোদ হোমাগাই। আজ তাঁদের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আগামীতে বিদেশেও পাড়ি জমাবে 'ওয়াও মোমো'।

আরও পড়ুন

সাদা রঙের নরম তুলতুলে মাংস বা সবজির পুর ভরা এক প্লেট মোমো, সঙ্গে সস আর সবুজ চাটনি, আহা এ এক স্বর্গীয় স্বাদ! স্ট্রিটফুড হিসেবে ফুচকা, এগরোল, চাউমিন, কাটলেটের পাশাপাশি বাঙালির রসনাতৃপ্তির তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে জনপ্রিয় তিব্বতি খাবার মোমো। রাস্তার ধারের দোকানের মোমো তো সকলেই একবার করে চেখে দেখেছেন, কিন্তু ব্র‍্যান্ডেড মোমোর কথা কি জানেন? হ্যাঁ, কলকাতার ব্র‍্যান্ডেড ‘ওয়াও মোমো’ (Wow Momo) এরই মধ্যে বেশ বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে। তাঁদের বিখ্যাত ট্যাগলাইন, “You will never go hungry when wow! Branch is nearby!”

কলকাতায় ওয়াও মোমোর কাউন্টার

ওয়াও মোমো শুধু কলকাতা শহরেই নয়, রয়েছে চেন্নাই, মুম্বাই, দিল্লি, পুনে, ব্যাঙ্গালোর, ভুবনেশ্বরের মতো বড় বড় শহরগুলিতে। তো কেমন ছিল এই ওয়াও মোমো-এর যাত্রাপথ? কিভাবেই বা তারা এত জনপ্রিয়তা পেল একাধিক বড় শহরগুলিতে? ২০০৮ সাল, কলকাতার যাদবপুরে দুই কলেজ পড়ুয়া সাগর দারিয়ানি এবং বিনোদ হোমাগাই ঠিক করলেন তাঁরা নিজেদের ব্যবসা শুরু করবেন। হাতে মূলধন ছিল ৩০ হাজার টাকা।

একটি অনুষ্ঠানে সাগর দারিয়ানি এবং বিনোদ হোমাগাই

সাগর এবং বিনোদ দুজনেরই পড়াশোনা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে। কিসের ব্যবসা করবেন ভাবতে ভাবতেই ঠিক করে ফেললেন তাঁরা মোমো বানাবেন। সেসময় কলকাতা শহরের মানুষ এই খাবারটির সঙ্গে যথেষ্ট সুপরিচিতই ছিলেন। ব্যাস, নিজেদের ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে লাগিয়ে শুরু করলেন পথ চলা। প্রথম থেকেই তাঁদের মোমোর বেশ কদর ছিল শহর জুড়ে। দু বছর পর অর্থাৎ ২০১০ সালে কলকাতার বৃহত্তম ফ্যাশন হাব ‘বিগ বাজার’ (Big Bazaar)-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় সাগর এবং বিনোদের ওয়াও মোমো।

এ ছিল তাঁদের কাছে এক বড় সাফল্য। পরের বছরই ২০১১ সালে ব্যাঙ্গালোরে গড়ে ওঠে ওয়াও মোমো-র একটি শাখা। তারপর থেকে ধীরে ধীরে পুনে, মুম্বাই, চেন্নাইয়ের একাধিক শপিং মলগুলিতে নতুন ঠিকানা হয় ওয়াও মোমোর। শুরুতে মাত্র দুজন রাঁধুনি আর একটি রান্নাঘর নিয়ে শুরু হয় সাগর আর বিনোদের ওয়াও মোমো। আজ এই ওয়াও মোমো প্রাইভেট লিমিটেডের আউটলেট সংখ্যা প্রায় ২৭১। শুধু তাই নয়, কেরলে তাঁদের তিনখানা ফ্র‍্যাঞ্চাইজিও রয়েছে।

২০১৮ সালে তাঁরা চালু করেন নিজেদেরই একটি ইনহাউস পানীয়, নাম ‘থান্ডারস’ (Thunderzz). ওয়াও মোমো-তে মোমোর চিরাচরিত স্বাদের পাশাপাশি রয়েছে ১৭ ধরনের প্রায় ১১ টি ভিন্ন স্বাদের মোমো। তার মধ্যে রয়েছে, বেকড মোমো, চকলেট মোমো, ম্যাঙ্গো মোমো, গন্ধরাজ চিকেন মোমো, তন্দুরি মোমো, বার্গার মোমো, চিজ মোমো, ডেজার্ট মোমো। শুধু তাই নয়, ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষ্যে তাঁরা হার্ট শেপের মোমো বানিয়ে উপহার দিয়েছেন মানুষকে। রোজ ডে তে বানিয়েছেন বিশেষ মোমো, যা তৈরি করা হয়েছে গোলাপ ফুলের আদলে।

ওয়াও থান্ডারস

নিজেদের ব্যবসা প্রসঙ্গে ওয়াও মোমোর কর্ণধার সাগর জানান, “আমার ভীষণ পছন্দের একটি খাবার মোমো। কত যুগ ধরে মানুষ এটি খাচ্ছে। আমরা প্রথম যখন ব্যবসা আরম্ভ করি, তখন কলকাতার এক্সাইড মোড়ে এক প্লেট মোমো পাওয়া যেত মাত্র ১০টাকায়। আমরা চালু করলাম ৪৫ টাকা প্লেট। শুধু পেঁয়াজ আর বাঁধাকপির বদলে, আমরা পুরোটাই বানালাম মাংস দিয়ে। মানুষের তা ভালো লেগে গেল। ৪৫ টাকা প্লেট বলে কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয়নি ওয়াও মোমোর থেকে।”

সাগর দারিয়ানি

“আসলে ব্যবসার ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, আমি যে জিনিসটা মানুষের কাছে বিক্রি করছি, সেটা কেমন ভাবে তুলে ধরছি তাদের কাছে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই আছেন যারা ভালো খাবার বানায়, কিন্তু আমরা খাবারটাকে ভালো বানাতে চেষ্টা করেছি। আমার বাবার ছিল জামাকাপড়ের দোকান। ছোট বয়স থেকেই ছুটির দিনগুলোতে দোকানে বসতাম বাবার সঙ্গে। দোকানে আসা খদ্দেরদের শার্ট, প্যান্ট পছন্দ করিয়ে দিতাম। কোনটার সঙ্গে কোন রঙ মানাবে, তা বলে দিতাম। যে জামাটা বিক্রি হয়না বলে বহুকাল ধরে পড়ে আছে, সেটারও ভোল পাল্টে কায়দা করে বিক্রি করে দিতাম। ব্যবসার ক্ষেত্রে এই কায়দাটাই খাটে, ওই বুদ্ধি এবং কায়দাকে কাজে লাগিয়েই আমাদের ওয়াও মোমোর পথ চলা শুরু”, জানিয়েছেন সাগর।

বর্তমান অর্থবর্ষের হিসেবে ওয়াও মোমোর টার্ন ওভার প্রায় ২০০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। ওয়াও মোমোর আর এক প্রতিষ্ঠাতা বিনোদ বলেন, “সেই ২০০৮ সাল থেকে আজ ২০২২ সাল, কত পথ যে পার করেছে আমাদের ওয়াও মোমো! সেই জার্নির একটা প্রদর্শনী রয়েছে আমাদের সংস্থার কর্পোরেট অফিসের কাউন্টারে। এর আগে ২০১৬ সালে ব্যবসার ক্ষেত্রে এক বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হই আমরা। তা হল, নোটবন্দি। আর পরের ধাক্কাটা আসে কোভিডের সময়। প্রায় ৩৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল আমাদের ব্যবসায়। তবে ভেঙে পড়িনি আমরা। শুরু করেছিলাম হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা। এখনও তা সুন্দরভাবেই এগোচ্ছে।”

ওয়াও মোমোর বিখ্যাত গন্ধরাজ চিকেন মোমো

বিনোদ আরও জানান, “আমি নিজে যেহেতু একজন নেপালি, তাই ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে মোমো তৈরির পদ্ধতি দেখে এসেছি এবং নিজেও বানিয়েছি একাধিকবার৷ কলকাতার মানুষ দেখলাম মোমো খুব পছন্দ করে। ব্যবসা শুরুর দিকে আমরা প্রায় ১৫ দিন পরপর একটা করে নতুন অফার দিতাম। তিনটে কিনলে একটা বিনামূল্যে এরকম ধরনের। তাতে দেখলাম ব্যবসা আরও বেড়ে গেল।”

উল্লেখ্য, শুধু ওয়াও মোমোই নয়, ‘ওয়াও চাইনিজ‘ নামেও তাঁদের একটি নতুন শাখা রয়েছে। তাতে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় চাইনিজ খাবার পাওয়া যায়। এখন বাজারে ইনস্ট্যান্ট প্যাকেটজাত মোমো এসে গিয়েছে। তা খুব চটজলদি বানিয়ে ফেলা যায়। খুব শীঘ্রই এই মোমো বানানোর যন্ত্র আনা হবে কলকাতায় বলে সাগর জানিয়েছেন। বাঙালির প্রিয় সৈকত শহর দীঘাতেও তাঁদের দুটি কাউন্টার রয়েছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ১৭ টি শহরে ওয়াও মোমোর একাধিক কাউন্টার তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে সংস্থার দুই কর্ণধার সাগর এবং বিনোদের স্বপ্ন, কলকাতা এবং একাধিক শহরের পাশাপাশি ওয়াও মোমো পাড়ি দেবে বিদেশে। আমেরিকার খাবার যদি কলকাতায় এত জনপ্রিয়তা লাভ করে, তবে কলকাতার খাবার আমেরিকায় কেন না! আমেরিকার পাশাপাশি ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, দুবাই, ইউরোপের মানুষ চেখে দেখবে কলকাতার ওয়াও মোমোর স্বাদ, এমনটাই ইচ্ছে সাগর এবং বিনোদের। 

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close