এ যেন আবার নতুন করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি পরিচালক সত্যজিৎ রায়। গত কয়েক মাস আগেই তুমুল উত্তেজনা শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়, অবিকল সত্যজিতের মতো তাকানো, আঙুলের ফাঁকে সেই একইভাবে সিগারেট ধরার কায়দা, চেয়ারে বসার ভঙ্গিমা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সক্কলের। সিনেমার পর্দায় সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে অভিনয় করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছেন অভিনেতা জিতু কমল। ছবির পরিচালক অনীক দত্ত জিতুর মধ্যে দিয়েই সত্যজিৎ রায়কে এক্কেবারে জীবন্ত করে তুলেছেন।
অনীক দত্ত পরিচালিত এই ছবির নাম ‘অপরাজিত’, ছবিটি বড়পর্দায় মুক্তি পাচ্ছে আগামী ১৩ মে। ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি‘ মুক্তি পেয়েছিল। মূলত সেই ছবি তৈরির নেপথ্যের ঘটনাবলী নিয়েই অপরাজিত নির্মাণ করেছেন পরিচালক অনীক দত্ত। ছবিতে চরিত্রগুলির নাম কিছুটা উলটে পালটে দিয়েছেন পরিচালক, ছবির মূল চরিত্র অপরাজিত রায় ওরফে অভিনেতা জিতু কমল। আর, তিনি তৈরি করছেন ‘পথের পদাবলী’ নামক একটি ছবি। সত্যজিতের পথের পাঁচালি নামের বদলে পরিচালক পথের পদাবলী নাম দেন। পথের পাঁচালি তৈরির সময় যে বাধা বিপত্তির মধ্যে দিয়ে ছবি করতে হয় সত্যজিৎ রায়কে, সেই কাহিনীই আমরা অনীক দত্তের এই সিনেমার মাধ্যমে দেখতে পাব।
প্রসঙ্গত, সত্যজিতের চরিত্রে জিতু কমল অভিনয় করছেন শুনেই নানা জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে যায় নেট দুনিয়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় জিতুর প্রথম লুক প্রকাশ্যে আসার পর রীতিমতো বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছেন সকলে। ছবির প্রথম টিজার লঞ্চের পর সত্যজিৎ রায় ওরফে জিতুর কণ্ঠস্বর শুনেও চমকে গিয়েছেন প্রায় সবাই। জিতুর এই লুক থেকে শুরু করে কণ্ঠস্বর বদলে ফেলার কাহিনী মোটেই সহজ ছিল না। এর পেছনে জিতু অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন দিন রাত এবং তাঁর এই পরিশ্রমের সাক্ষী থেকেছেন স্ত্রী নবনীতা দাস।
ছবিতে সত্যজিতের মতো অবিকল দেখানোর জন্য জিতুকে অবশ্যই প্রস্থেটিক মেকাপ করতে হয়েছে। কিন্তু এই মেকাপই তো আর নিজের রূপ বদলে ফেলার শেষ কথা নয়। সত্যজিতের ভূমিকায় অভিনয় করতে জিতুকে নিজের শারীরিক গঠনেও পরিবর্তন আনতে হয়েছে। পালটে ফেলতে হয়েছে নিজের দাঁতের পাটির চেহারা। জিতুর স্ত্রী নবনীতা এই প্রসঙ্গে জানান, “সত্যজিৎ রায়ের দাঁতের আদল রপ্ত করতে নিজের দাঁতগুলো ঘষে ঘষে, তার ওপর ক্যাপ পরে, কি অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেছে জিতু। নবনীতা নিজে রক্ত দেখে ভয় পান বলে, একাই দাঁতের ডাক্তারের কাছে যান জিতু। সত্যজিৎ রায়ের দাঁতগুলো বেশ ফাঁকা ফাঁকা, এই লুক আনতে দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে ঘষে ঘষে দাঁতের মাঝের ফাঁক বাড়িয়েছেন তিনি। দাঁতের এই যন্ত্রণা যে কি অসহ্য, সেটা শুধু সেই জানে যে ভোগ করেছে। অনেক শিল্পীই রয়েছেন, যাঁরা শিল্পের স্বার্থে নিজস্বতাকে ত্যাগ করেছেন বহু পরিশ্রম করে৷ আমার মনে হয় শিল্পী হওয়ার জন্য ছোট ছোট এই নেপথ্যের গল্পগুলো সবার সামনে আসা খুব দরকার।”
উল্লেখ্য, এর আগেও জিতুর স্ত্রী নবনীতা জানিয়েছিলেন জিতুর সত্যজিৎ রায় হয়ে ওঠার দিনগুলোর গল্প। প্রতিদিন ভোর ৫টায় অ্যালার্ম বাজার আগে থেকেই উঠে বসে থাকতেন নবনীতা, জিতুর সমস্ত জিনিস হাতের কাছে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। কখনও চা দিতে দেরি হলে বা রান্নার মাঝে শব্দ হলে রাগে চেঁচিয়ে উঠতেন জিতু। আসলে সেই সময় একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন অভিনেতা। সফল ভাবে কাজটা শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। নবনীতাও বুঝতেন সেইসময় তাঁর মানসিক অবস্থাগুলো। ফলে তা নিয়ে কখনও ঝামেলা করতেন না তিনি।
জিতুর নিজের কাজের প্রতি, শিল্পের প্রতি এই শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা দেখে প্রশংসা করেছেন বহু মানুষ। খুব কম মানুষেরই কাজের প্রতি এমন নিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। জিতু যে পরিশ্রম করেছেন, তার সঠিক ফল তিনি অবশ্যই পাবেন। ছবির চরিত্রের জন্য আমার আমিত্ব কে ত্যাগ করা মোটেই মুখের কথা নয়। জিতুর এই মানসিকতা এবং সাহসিকতার পরিচয় সত্যিই কুর্নিশের দাবি রাখে।