অভিনেতা তথা পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সম্প্রতি পয়লা বৈশাখে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বায়োপিক ‘অভিযান‘ মুক্তি পেয়েছে। ওঁনার অভিনীত শেষ ছবি ‘বেলাশুরু’ আর কিছুদিন বাদেই মুক্তি পেতে চলেছে। উল্লেখ্য, পরমব্রত পরিচালিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বায়োপিক অভিযান মুক্তি পাবার পরেই নানা বিতর্কে জড়িয়েছে। পরিচালক পরমব্রতর বিরুদ্ধে উঠেছে তথ্য বিকৃতির অভিযোগ। শুধু তাই নয়, এই ছবির কিছু দৃশ্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপত্তি প্রকাশ করেছেন প্রয়াত কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্রের কন্যা পৌলমী বসু এবং তাঁর এক আত্মীয়। পৌলমীর বক্তব্য, “আমি জানি না বাপি এমন কোনও দৃশ্যে অভিনয় করতে কেন সম্মতি জানালেন যার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার কোনও মিল নেই।”
সৌমিত্র কন্যা পৌলমী সরাসরি এই নিয়ে আক্রমণ করেছেন পরিচালক পরমব্রতকে। পরমব্রত এই বিষয়ে জানান, “আমি খুব সারপ্রাইজড হয়েছি। কারণ, পৌলমীদির সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক। সে সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে বলছি, এই ছবিটি তৈরি করেছি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। ছবিটি আর অন্য কাউকে নিয়ে নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের কিছু ঘটনার মাধ্যমে তাঁর জীবন দর্শনকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মূলত। সেই কাজ করতে গিয়ে ছবিতে যেসব ঘটনা আনবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছি, সেটুকুই এনেছি। সেটা টাইম প্রেজেন্টে হোক কিংবা ফ্ল্যাশব্যাকেই হোক।”
পৌলমী রীতিমতো হতাশ এবং বিরক্ত হয়েই জানিয়েছেন, “এখন তাঁর হাত বাঁধা। কারণ, বাপি নিজেই ঐ ছবিতে অভিনয় করেছেন। যে দর্শকরা তাঁদের পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানেন না, তারা এই ছবিটা দেখে নিজেরা একটা ধারণা তৈরি করে নেবেন নিজেদের মতো। আর, বাপির জীবনের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে কষ্ট অনুভব করবেন। আমার কিছু বিষয় নিয়ে সন্দেহ আছে। তার কারণ, বাস্তব এবং কল্পনাকে মেলালে যে কি ক্ষতি হতে পারে তা হয়তো বাপি তখন বুঝতে পারেননি। শুধু তাই নয়, বাপির জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে এই বায়োপিকে বাদ দেওয়া হয়েছে।”
এই প্রসঙ্গে বিতর্ক উঠতেই পরমব্রত মুখ খোলেন, স্পষ্টতই তিনি জানান, “সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর কন্যা পৌলমী বসু দুজনেই এই ছবির চিত্রনাট্য সম্পর্কে জানতেন। এমনকি পৌলমী দি কিছু দৃশ্যে আমায় সাহায্যও করেছেন। তাহলে তখন তিনি আপত্তি তুললেন না কেন? দু বছর পর যখন ছবি মুক্তি পেল তখন এই আপত্তি কেন? যাঁকে নিয়ে ছবি তাঁর অনুমোদন পাওয়ার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সৌমিত্র জেঠু সোৎসাহ নিয়ে এই ছবি করার জন্য আমায় সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে তিনি এই ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। এর উপরে তো আর কোনও বৈধতার প্রশ্ন উঠছে না। আমি আমার শৈল্পিক স্বাধীনতা অনুযায়ী চিত্রনাট্য সাজিয়েছি, তা কারও খারাপ লেগে থাকলে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। অনেকেরই মনে হতে পারে, ছবিতে এটা নেই কেন, ওটা নেই কেন? প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত থাকবেই। এখন ছবিতে যা রয়েছে, তা নিয়ে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাহলে শুধু আমাকে নয়, আঙুল তুলতে হবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দিকেও। সেটা মনে এই সময়ে দাঁড়িয়ে উনি ডিসার্ভ করেন না। তাই বলছি, এসব নিয়ে বিতর্ক না বাড়ানোই ভালো, কারণ এগুলো করা মানে শুধু শুধু ওঁনাকে আমরা কষ্ট দিচ্ছি।”
প্রসঙ্গত, পৌলমী বসুর বোন তথা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আরেক আত্মীয়া শ্রমণা ঘোষ এই ছবির বিষয়ে নানা বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন। তাঁর দাবি, “পরমব্রত নির্মিত এই ছবিতে এমন কিছু দৃশ্য দেখানো হয়েছে যা ভ্রান্ত। যেভাবে ছবিতে দেখানো হয়েছে যে, নাতি রণদীপের দুর্ঘটনার পর তার চিকিৎসার ক্ষেত্রে অর্থ জোগাড় করার জন্য সৌমিত্র বাবুকে প্রচুর ছবি করতে হয়েছে, তা এক্কেবারেই ঠিক নয়। এতে সৌমিত্র বাবুর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে।”
পৌলমী পুত্র রণদীপ তথা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাতির এই বিষয়টি নিয়ে পৌলমী জানান, “আমার পুত্র রণদীপের যে দৃশ্যটি রাখা হয়েছে বায়োপিকে, তা অন্য মাত্রায় বিরক্তিকর হয়ে উঠছে। আমার মনে আছে, বাপি বলতেন, কীভাবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সন্তান সোমির মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ দিয়ে বাপিই আমাদের মনকে শক্ত করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জীবনে শুধু এগিয়ে যেতে হয়। ছবিতে রণদীপের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার কাল্পনিক বর্ণনা করা হয়েছে। পরিচালক নিজের চরিত্রটিকে মহিমান্বিত করতে হাসপাতালে কাটানো রণদীপের এপিসোডটি যেভাবে দৃশ্যায়িত করেছেন, তা দেখে আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছি, হতাশ হয়েছি।”
তবে, পরিচালক পরমব্রত এই ছবিটি নির্মাণ করার সময় থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই ছবি মুক্তি পাবার পর ছবি ঘিরে নানা তর্কবিতর্ক উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ছবির প্রচারের সময় তিনি নিজেই নানা জায়গায় সেই ভয়ের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। বিতর্কের ঝড় যে এভাবে শুরু হতে পারে, তা তিনি আঁচ করতে পারেননি। তাই পৌলমী বসুর এমন প্রতিক্রিয়া দেখে রীতিমতো আশ্চর্যই হন পরমব্রত। উল্লেখ্য, এই ছবিতে যুবক সৌমিত্রের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছে অভিনেতা যীশু সেনগুপ্তকে।