প্রয়াত বর্ষীয়ান চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার। গত কয়েকদিন ধরেই অসুস্থতার কারণে এসএসকেএম আইসিইউ-তে (SSKM ICU) ভর্তি ছিলেন তিনি। কোভিড টেস্টও করা হয়েছিল তাঁর। তাঁর চিকিৎসার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ডও গঠন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। চেস্ট মেডিসিনের ডাক্তার সোমনাথ কুন্ডু, মেডিসিনের ডাক্তার সৌমিত্র ঘোষের নেতৃত্বে এই মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তিনি কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন। তারপর বয়সজনিত কারণ তো আছেই। শুধু কিডনিই নয়, পাশাপাশি ডায়াবেটিস এবং ফুসফুসেরও সমস্যা দেখা দেয় তাঁর। গতকাল তাঁর শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় তাঁকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়।
মৃত্যকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গত ১৪ জুন আচমকা অসুস্থ হয়ে তিনি এসএসকেএম-এ ভর্তি হন। বয়সজনিত কারণের পাশাপাশি নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। তাঁর কোভিড পরীক্ষাও করা হয়। একটানা ডায়ালিসিসও চলছিল তাঁর। সুস্থ করে তোলার সমস্তরকম চেষ্টা চালিয়েছেন চিকিৎসকরা। আজ সকালে তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি অতি সংকটজনক হয়ে ওঠে। গত কয়েকদিন ধরেই শরীরে ইনফেকশন দেখা দিয়েছিল পরিচালকের। সমস্ত চেষ্টার অবসান ঘটিয়ে জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে আজ সকালে অর্থাৎ ৪ জুলাই হেরে গেলেন তিনি।
তাঁর প্রয়াণে এককথায় বাংলা সিনেমা জগতের একটা বর্ণময় অধ্যায়ের ইতি হয়ে গেল। আজ সকালে ১১.১৭ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। তরুণ মজুমদার তাঁর ছবিতে সারল্যের গল্প বলতেন। যৌথ পরিবারের গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন তিনি। এক অন্যরকম ভালোবাসার গল্প শোনাতেন তাঁর ছবির মাধ্যমে। নিজেও খুব সহজ মানুষ ছিলেন তিনি।
এক অন্য ধারার, ভিন্ন রুচির একাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে- ‘বালিকা বধূ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘আলো’, ‘চাঁদের বাড়ি’, ‘পলাতক’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘গণদেবতা’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘পথভোলা’, ‘শহর থেকে দূরে’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘ঠগিনী’, ‘কুহেলী’, ‘কাঁচের স্বর্গ’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘পরশমণি’, ‘আপন আমার আপন’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘পথ ও প্রাসাদ’, ‘যদি জানতেম’, ‘আলোর পিপাসা’ এসব চলচ্চিত্র মানুষের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। চলচ্চিত্রের জন্য একাধিক পুরস্কার এসেছে তাঁর ঝুলিতে। পাঁচটি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, চারটি জাতীয় পুরস্কার, সাতটি বি.এফ.জে.এ সম্মান, আনন্দলোক পুরস্কারে সম্মানিত হন তিনি।
১৯৯০ সালে তাঁকে ‘পদ্মশ্রী‘ সম্মানে ভূষিত করা হয়। বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের তিনটি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। স্বপ্ন দেখা শেখাতে জানতেন এই মহান পরিচালক। তাঁর অনেকগুলি চলচ্চিত্রই সাহিত্য নির্ভর। একাধিক লেখক যেমন বিমল কর, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকীর্তি বড়পর্দায় তুলে ধরেছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথের গান ভীষণ ভালোবাসতেন তরুণ মজুমদার। তাঁর একাধিক ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার দেখা যায়। তাঁর ছবিতে কোনওদিনই গ্ল্যামারের উচ্ছ্বাস ছিল না। কিন্তু, প্রত্যেকটা ছবিতেই সহজ জীবনের জয়গান ছিল। নিজের গণ্ডির বাইরে কোনওদিনই বেরোলেন না তিনি। বাঙালির খুব চেনা ছবি, রঙ, গন্ধ, পরিবেশ এবং মানুষদের সঙ্গে নিয়ে কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন।
তৎকালীন পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন প্রমুখদের মধ্যে তরুণ বাবু এক অন্য ঘরানার ছবি উপহার দিলেন দর্শকদের। যা খুব চেনা, খুব সহজ, কিন্তু আবার নিছক বিনোদন নয়, এমনটাই বলতে চাইতেন তিনি। তাঁর ছবির স্ক্রিপ্ট পরিবারকে একসঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকবার অনুপ্রেরণা জোগায়। ২০১৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী‘ অবলম্বনে প্রথম ধারাবাহিক তৈরি করলেন।
এককথায় খাঁটি বাঙালি ছিলেন তিনি। মফস্বলি সংস্কৃতি, অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা, একান্নবর্তী পাড়া, কৈশোরের পবিত্রতা, রবীন্দ্রজয়ন্তী, গোবেচারা এক ছেলে, পাড়াতুতো কাকিমা, বৌদি, ঘাট বাঁধানো পুকুর, ভোরের আলো, কনকনে শীতের সকাল, মেঠো পথ, বসতবাড়ির টিনের চাল, শাপলা শালুক ফুলে ভরা টলটলে দীঘি, বাঁশবন, নারকেল গাছের সারি, কত রঙের গ্রাম পলাশবনী, বাতিকর, বাতাসপুর, খয়রাশোল, মন্দিরা সবকিছু নিয়ে চলে গেলেন তিনি।
তাঁর ছবি তৈরীর কথায়, “জীবনের যত জটিলতাই ছবির ভেতর দিয়ে প্রকাশ করানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, স্পষ্টত তা যেন দর্শকের কাছে জলবৎতরলম বলে মনে হয়।” তরুণ মজুমদারের ছবি দেখবার পর কোনও দর্শক বলেননি, “সব মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।” আমৃত্যু তিনি নিজের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। চলচ্চিত্রে তিনি যেমন নিজের ধারা বজায় রেখেছেন, ঠিক তেমনই নিজস্ব ধারায় তিনি ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে‘ নামক একটি বই রচনা করেছেন। যে বই অত্যন্ত সহজ, মর্মস্পর্শী এবং সর্বজনগৃহীত।
আজ তাঁর প্রয়াণে গোটা চলচ্চিত্র জগত শোকস্তব্ধ। ওঁনার সৃষ্টির মাধ্যমে উনি অমর থাকবেন। আজীবন আবালবৃদ্ধবনিতার হৃদয়ে রয়ে যাবেন তরুণ মজুমদার।