Sri Lanka: চরম অর্থনৈতিক সংকট শ্রীলঙ্কায়

চরম আর্থিক সঙ্কটে শ্রীলঙ্কা। ডুবে গিয়েছে দেশের অর্থ ব্যাবস্থা।

আরও পড়ুন

ভয়াবহ আর্থিক সংকটে ধুঁকছে শ্রীলঙ্কা। উচ্ছ্বাস এবং উদযাপনের এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে আচমকা এই পরিস্থিতি কিভাবে নেমে এল, তা নিয়ে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়েছে। শ্রীলঙ্কা মানেই আমাদের মনের চোখে ভেসে ওঠে বিদেশি পর্যটকে গিজগিজ করা সমুদ্র সৈকত, চিনা সংস্থাগুলির আকাশছোঁয়া ঝলমলে বহুতল, ঝাঁ চকচকে সব মসৃণ রাস্তা। কিন্তু, হঠাৎই কয়েকদিনের মধ্যে শ্রীলঙ্কার এই ছবিগুলো বদলে গেল। রাস্তায় আলো নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঘরে ঘরে রান্নার গ্যাস নেই, পকেটে টাকা থাকলেও বাজারে মিলছে না প্রয়োজনীয় সামগ্রী, উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত দু বেলা খেতে পাচ্ছে না। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এমন দুর্দশা কখনও দেখেনি দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটির মানুষ। 

বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট কার্যত বেসামাল করে তুলেছে শ্রীলঙ্কার সম্পূর্ণ অর্থনীতিকে। এর পাশাপাশি, শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের আরেকটি কারণ হল বৈদেশিক ঋণের ভার। দেশটিতে কাগজের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এখন দুর্লভ। লাটে উঠেছে শ্রীলঙ্কার স্কুলগুলি, পড়াশোনা প্রায় বন্ধ। কাগজ কালির অভাবে সমস্ত পরীক্ষা বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়েছে স্কুলের শিক্ষকরা। কাগজ কালির সংকটের কারণ হল, এই দুটো সামগ্রী শ্রীলঙ্কাকে অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হয়, এই মুহুর্তে তাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নেই কাগজ কালি আমদানি করার জন্য। দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা থাকছে লোডশেডিং।  ফলে ইন্টারনেট পরিষেবারও যাচ্ছেতাই অবস্থা। রাস্তার আলোও জ্বালানি বাঁচাতে বন্ধ রাখছে সরকার, এমনকি জেনারেটর ব্যবহার করবার জন্য যেটুকু তেল প্রয়োজন সেটুকুও নেই তাদের কাছে৷ রাশিয়া এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের জেরে পৃথিবীর তৈল ভান্ডারে এমনিতেই ভাটা পড়েছে। বর্তমানে যার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে শ্রীলঙ্কায়।

বিক্ষোভে রাস্তায় নেমেছে শ্রীলঙ্কাবাসী

উল্লেখ্য, শ্রীলঙ্কায় গত ২০০৯ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে গৃহযুদ্ধ  চলেছে। তার ফলে সেই দ্বীপরাষ্ট্রের আর্থিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি এখনও যে খুব ভালো অবস্থায় রয়েছে তা নয়। যদিও, সেই অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সেরে উঠছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু বর্তমানের এই পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কাকে একেবারে অথৈ জলে ফেলে দিয়েছে বলা যায়। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলেন গোটাবায়া রাজাপাক্ষ। ২০১৯ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু সমস্যা হল, গোটাবায় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শুরু করে। ২০১৯ এ শ্রীলঙ্কায় ভ্যাট এবং অন্যান্য সমস্ত কর কমানোর কথা বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট। নির্বাচনের অভিযানেও তিনি এই কথাই বারবার বলেন। প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে শ্রীলঙ্কায় কর কমানোও হয়েছিল, ১৫ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল ভ্যাটের পরিমাণ। অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যেই সেই সময় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু, তাও টিকল না, ২০২০ এর করোনা প্রকোপ সব ভেস্তে দিল। 

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাক্ষ

মূলত, শ্রীলঙ্কার অর্থ ভান্ডারে চাপ বাড়তে শুরু করল নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর। দেশি বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলঙ্কা সরকার ব্যাপক হারে ঋণ গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় করেছে বেশি। ঋণ পরিশোধ করবে কিভাবে তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি সেদেশের সরকার। ফলে, বর্তমানে শ্রীলঙ্কার অর্থ ভান্ডার প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। চীনের প্রেসিডেন্ট সে সময় অর্থনৈতিক সাহায্যের  আশ্বাস দিয়েছিল  শ্রীলঙ্কাকে। কিন্তু, কয়েক মাসের মধ্যেই ভোল পালটে গেল চীনের। শ্রীলঙ্কাকে চড়া সুদে ঋণ দিয়েছিল চীন, সঙ্গে ছিল একাধিক শর্তাবলী। শ্রীলঙ্কা সে সময় স্থির করে যে, তাদের দেশে যে সমস্ত পণ্য উৎপাদন হয়, সেগুলো তারা বিদেশে রপ্তানি করে চীনের ঋণ পরিশোধ করবে ধীরে ধীরে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি, তাদের ধারণা ভুল ছিল। শ্রীলঙ্কায় উৎপাদিত দুটি উল্লেখযোগ্য জিনিস হল চা এবং নারকেল। এই দুটো জিনিস বিদেশে রপ্তানি করে তারা বেশ ভালো পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারত। এদিকে বাংলাদেশ এবং চীনের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে বেশ বড়সড় একটি কাপড়ের ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে শ্রীলঙ্কাতে, সেটাও চীনের হস্তক্ষেপের ফলে এখন চরম দুর্দশায় রয়েছে। শ্রীলঙ্কার কাপড়ের এই ইন্ডাস্ট্রিটি কার্যত শেষ করে দিয়েছে চীন। অন্যদিকে, করোনা মহামারির পর শ্রীলঙ্কার চা এবং নারকেলের বিক্রিও কমে গিয়েছে। শ্রীলঙ্কা ইরানের কাছ থেকে যা ঋণ নিয়েছিল তা পরিশোধ করতে প্রতি বছর ৫ মিলিয়ন ডলার পরিমাণ চা ইরানে রপ্তানি করার শর্ত গ্রহণ করেছিল শ্রীলঙ্কা। সুতরাং, বর্তমানে চায়ের বাজারজাতকরণ এবং রপ্তানি করা কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত। চীন এদিকে ঋণ পরিশোধের জন্য রীতিমতো চাপ দিতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কাকে। টাকা শোধ করতে না পেরে চীনের শর্ত গ্রহণ করে শ্রীলঙ্কা তাদের  সমস্ত বন্দর চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দিতে বাধ্য হয়েছে। 

জ্বালানি নিয়ে বিক্ষোভ, গ্যাস সিলিন্ডার হাতে নিয়ে নেমেছে মানুষ

শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ আসে পর্যটন শিল্পের থেকে। গত দু বছর করোনার প্রকোপে পর্যটন শিল্পের কাজকর্মও রীতিমতো বন্ধ হয়ে গিয়েছে শ্রীলঙ্কায়। সে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি বড় জায়গা হল বিভিন্ন  দেশে শ্রীলঙ্কার কর্মরত নাগরিকদের মারফত পাঠানো বিদেশি ডলার। কিন্তু, তাও হ্রাস পেয়েছে এই করোনা মহামারির ফলে। মহামারির পূর্বে পর্যটন এবং রেমিট্যান্স থেকেই শ্রীলঙ্কা প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারত। এখন তা কার্যত বন্ধ। কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পও দেশটির আর্থিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শ্রীলঙ্কা গ্রহণ করেছিল একাধিক মেগা প্রকল্প। তার মধ্যে নানা ধরনের সমুদ্র বন্দর, রাস্তা, বিমান বন্দর সহ আরও অন্যান্য প্রকল্প রয়েছে। প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে কলম্বো পোর্ট সিটি নির্মাণ করা শুরু করেছিল শ্রীলঙ্কা। যা শেষ হতে প্রায় ২৫ বছর সময় লাগবে। এই সমস্ত প্রকল্পের লোভ মূলত চীনই দেখিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। 

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট  গোটাবায়া শ্রীলঙ্কার ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে শুরু হয় অর্গ্যানিক চাষ। আবার একটি ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। শ্রীলঙ্কার মাটি এমনিতেই নোনা, সেখানে কিভাবে অর্গ্যানিক চাষ সম্ভব তা নিয়ে এক বিন্দু চিন্তা ভাবনা করেনি সেদেশের সরকার। সরকারের তরফ থেকে, কৃষিকাজে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের প্রয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হল। সার আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হল রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে। তার উল্টো প্রভাব পড়ে গেল কৃষিক্ষেত্রে। গোটা দেশ জুড়ে উৎপাত শুরু হয়ে গেল পঙ্গপালের। শুধু তাই নয়, অর্গ্যানিক চাষের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল সেদেশের চা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে হু হু করে বেড়ে গেল খাদ্য পণ্যের দাম এবং খাদ্য আমদানির ফলে সেই সময়  বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। 

বর্তমানে, দেশটির প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন। সেই কারণে বিভিন্ন দেশের কাছে সাহায্য চাইছে শ্রীলঙ্কা। ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে শ্রীলঙ্কা সরকার। এই মুহুর্তে সে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা একটি দেশের জন্য অত্যন্ত কম। অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রচুর রপ্তানি করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। তার জন্য পণ্যের বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। বৈদেশিক বিনিয়োগ খুব গুরুত্বপূর্ণ এই সময়। একেই খুব ছোট রাষ্ট্র, ফলে সেখানে ব্যবসা করা মুখের কথা নয়। তার মধ্যে দেশের বাজেট এবং জিডিপি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত। এই সময় অপ্রয়োজনীয় খাতগুলিতে একেবারেই খরচ করা যাবে না বলে মত অর্থনীতিবিদদের। 

দেশ জুড়ে কারফিউ, পুড়ছে বাস

সূত্রের খবর, সম্প্রতি ঋণের আবেদন নিয়ে শ্রীলঙ্কার নতুন অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন। ওয়াশিংটন বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তারা জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলা প্যাকেজের অধীনে জরুরি ওষুধ কেনার জন্য এক কোটি ডলার তাৎক্ষণিক ছাড় দিয়েছে। পাশাপাশি, রান্নার গ্যাস, ধান এবং সার কেনা, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ এবং অন্যান্য নিত্যসামগ্রীর জন্য আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ নিয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আলোচনা করছে ওয়াশিংটনের বিশ্বব্যাংক। শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক আনুমানিক ৫০ কোটি ডলার দিয়ে সাহায্য করবে শ্রীলঙ্কাকে।

এদিকে, গতকাল পদত্যাগের দাবিতে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাক্ষের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙে তারা প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করেন। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাক্ষের ছোট ভাই এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাক্ষের নামে “বিদায় নাও গোটা” লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে এদিন বিক্ষোভ করেন ছাত্রছাত্রীরা।

প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা

উল্লেখ্য, বর্তমানে শ্রীলঙ্কার ওপর যেভাবে চাপ বাড়তে শুরু করেছে, সেখান থেকে খুব শীঘ্র বেরিয়ে আসতে পারবে না দেশটি। এমনটাই মনে করছে অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। এটি শ্রীলঙ্কার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হতে চলেছে৷ 

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close