রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি কেনার বিষয়ে কি মুখ ঘুরিয়ে নিতে চাইছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন? ২০২২-এর শেষদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ই ইউ) রাশিয়ার জ্বালানি অর্থাৎ তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস কেনা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার জন্য ডাক দিয়েছে। কিন্তু এই ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত কোনও ঐক্যমতে পৌঁছনো সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার আগে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল রফতানির প্রায় অর্ধেক ইউরোপে যেত। তেল উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পরই রয়েছে রাশিয়া। কার্যত, রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (IEA) তথ্য অনুসারে, স্লোভাকিয়া গত বছর তাদের মোট তেল আমদানির ৯৬ শতাংশ করেছে রাশিয়া থেকে। হাঙ্গেরির ক্ষেত্রে এ হার ৫৮ শতাংশ। তেলের বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজে পেতে এ দেশ দুটিকে অতিরিক্ত এক বছর সময় দেওয়া হবে। ২০২০ সালে নেদারল্যান্ডস ও জার্মানি দৈনিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি রাশিয়ার তেল আমদানি করেছে। গত বছর যুক্তরাজ্যের মোট তেল আমদানির ৮ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। আর যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ হার ছিল ৩ শতাংশ।
গত মার্চে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বছরের মধ্যে গ্যাস আমদানি দুই-তৃতীয়াংশ কমাতে অঙ্গীকার করে। আরও কী করা যায়, তা নিয়ে জোটের মধ্যে আলোচনা চলছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন ঘোষণা করেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্য দেশগুলি যেন ২০২২ সালের পর রাশিয়ার তেল না কেনে, সে জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানির ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার কথা ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য ধীরে ধীরে চলতি বছরের শেষ দিক নাগাদ রাশিয়া থেকে তেল আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করবে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সদস্য হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া ২০২৩ সালের শেষ দিকে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ক্রয় চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যায়। এ যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া থেকে প্রতি মাসে প্রায় ২২ বিলিয়ন ইউরোর জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। অথচ ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়া থেকে মাসে গড়ে ১২ বিলিয়ন ইউরোর জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি করে। রাশিয়া সতর্ক করে বলেছে, তার তেল নিষিদ্ধ করলে তা বিশ্ববাজারের জন্য বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনবে।
মার্চের শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে বাইডেন জ্বালানির উচ্চমূল্য কমানোর প্রয়াসে আমেরিকার মজুত থেকে বড় ধরনের তেল সরবরাহ করার নির্দেশ দেন। কিছু দেশ, যারা আইইএর সদস্য, তারা তাদের মজুত থেকে ১২০ মিলিয়ন ব্যারেল সমতুল্য তেল সরবরাহ করেছে। বিষয়টি এই দেশগুলির ইতিহাসে তেলের রিজার্ভ থেকে সবচেয়ে বড় ব্যয়। গ্যাসের চেয়ে তেলের বিকল্প সরবরাহকারী খুঁজে পাওয়া সহজ হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। কারণ, কিছু তেল রাশিয়া থেকে আসে। এ ছাড়া অন্যত্র থেকেও তেলের প্রচুর যোগান আসে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র চায়, সৌদি আরব তার তেল উৎপাদন বাড়াক। এ ছাড়া ভেনেজুয়েলার তেল সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের জেরে পশ্চিমী বিশ্বের শক্তিগুলি রাশিয়ার ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জবাবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেন, অ-বন্ধুসুলভ দেশগুলিকে গ্যাসের জন্য রাশিয়ান মুদ্রায় (রুবেল) অর্থ পরিশোধ করতে হবে। একপর্যায়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি সংস্থা গাজপ্রম পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে তারা ঘোষণা করেছে, রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে অর্থ প্রদান না করলে এই সরবরাহ পুনরায় চালু করা হবে না। রুবলে অর্থ প্রদান করা হলে রাশিয়ার মুদ্রার পতন থামবে। দামও বৃদ্ধি হবে। সার্বিকভাবে রুশ অর্থনীতি উপকৃত হবে। ই ইউ বলেছে, তারা রাশিয়ার এ পদক্ষেপকে একধরনের ‘ব্ল্যাকমেল’ বলে মনে করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্য অনেক দেশ চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে একই সমস্যার মুখোমুখি হতে চলেছে। ইউক্রেনে হামলার পরও রাশিয়া ইউরোপের অনেক দেশে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।
রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কত তাড়াতাড়ি কমিয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে ই ইউ-ভুক্ত দেশগুলি দ্বিধাবিভক্ত। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন সতর্ক করে বলেছেন, রাশিয়ার দাবি মানার অর্থ ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলির যেসব কোম্পানি এ কাজ করে চলছে, তাদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। জার্মানি, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়াসহ ই ইউ-ভুক্ত কিছু দেশের কোম্পানি গ্যাসের জন্য গাজপ্রম ব্যাংকের মাধ্যমে ইউরোতে অর্থ প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। রাশিয়ার এই ব্যাংক গ্যাস বাবদ পেমেন্টকে রুবলে রূপান্তর করবে। সংবাদ সংস্থার সূত্রে খবর – অস্ট্রিয়া ও ইতালির গ্যাস কোম্পানিগুলিও গাজপ্রম ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার পরিকল্পনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র চলতি বছরের শেষ নাগাদ ইউরোপে অতিরিক্ত ১৫ বিলিয়ন ঘনমিটার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) পাঠাতে সম্মত হয়েছে। গ্যাসের জন্য ইউরোপ অন্য রফতানিকারকদের দিকে যেতে পারে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে কাতার, আলজেরিয়া বা নাইজেরিয়া। কিন্তু ইউরোপের চাহিদা অনুযায়ী দ্রুত গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই রফতানিকারকদের বাস্তবিক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপ জ্বালানিশক্তির অন্যান্য উৎস, যেমন বায়ুশক্তির ব্যবহার বাড়াতে পারে। কিন্তু তা যেমন দ্রুত সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়, তেমনি তা করা সহজও নয়।
রাশিয়া বেশ কয়েকটি প্রধান পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস পাঠায়। এ গ্যাস প্রথমে আঞ্চলিক সংরক্ষণাগারগুলিতে যায়। তারপর তা মহাদেশজুড়ে বিতরণ করা হয়। যদি ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বিশেষ করে ইতালি ও জার্মানি বড় ধরনের বিপদে পড়বে। কারণ, তারা সবচেয়ে বেশি গ্যাস আমদানি করে। ২০১৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করে, তার ৪১ শতাংশ রাশিয়া থেকে আসে। যুক্তরাজ্যকে প্রায় ৫ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। আর রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র কোনও গ্যাস আমদানি করে না।