কুতুব মিনার চত্বর ঘিরে বিতর্ক

আরও পড়ুন

বাবরি মসজিদ, জ্ঞানব্যাপী মসজিদ এবং তাজমহল নিয়ে বিতর্ক শেষ হতে না হতেই এবার নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছে দিল্লির কুতুব মিনার। হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠনের দাবি, এই স্থাপত্য মুসলিম রাজা কুতুবউদ্দিন আইবক তৈরি করেননি। এটি তৈরি করেছেন হিন্দু রাজা বিক্রমাদিত্য। এই মিনার নাকি সূর্যের গতিপথ পর্যালোচনার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। পঞ্চম শতকে রাজা বিক্রমাদিত্য এটি স্থাপন করেছিলেন। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন আঞ্চলিক অধিকর্তা ধর্মবীর শর্মা এমনটাই দাবি করেছেন। এমনকি, তিনি জানিয়েছেন তাঁর কাছে কুতুব মিনার সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য প্রমাণও রয়েছে।

কুতুব মিনার

ধর্মবীর শর্মার কথায়, “এবার ইতিহাসকে পুনরায় ঠিক করবার সময় এসে গিয়েছে। এই কুতুব মিনারকে আসলে বলা হত ‘ধ্রুবস্তম্ভ’। এটি তৈরি করেছেন স্থাপত্যবিদ বরাহমিহির। ২১ জুন বেলা ১২টায় দক্ষিণায়ন থেকে সূর্যের উত্তরায়ণ হয়। এই বিষয়টি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবার জন্যই মূলত কুতুব মিনার স্থাপন করা হয়। মিনারটি ২৫ ইঞ্চি হেলানো। মিনারটি এমনভাবেই তৈরি করা হয়েছে যাতে সূর্যের আলো পড়ে মিনারের কোনও ছায়া না তৈরি হয়।” 

তাঁর আরও দাবি, উপর থেকে এই মিনারকে দেখলে নাকি সূর্যমুখী ফুলের মতো মনে হয়। ২৭টি হিন্দু জৈন মন্দির ভেঙে ফেলার পর তার থেকে প্রাপ্ত সামগ্রী দিয়ে এই মন্দির স্থাপন করা হয়। সূত্রের খবর, ধর্মবীর শর্মার এই দাবির পর থেকেই হিন্দু এবং জৈন দেব দেবীর মূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে মামলা দায়ের করা হয়েছিল দিল্লির সাকেত আদালতে। জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের তরফ থেকে কুতুব মিনার চত্বরে খননের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। 

কুতুব মিনারের দক্ষিণ দিকে যে মসজিদ রয়েছে, তার থেকে ১৫ মিটার দূরে খনন কার্য শুরু করা হতে পারে, এমনটাই বলা হয়েছিল। কুতুব মিনার একটি সংরক্ষিত প্রাচীন সৌধ। সেখানে কোনওভাবেই পূজা অর্চনা করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। এর আগে কুতুব মিনারকে ঘিরে এক অন্য বিতর্কও শুরু হয়েছিল। মিনারের ভেতরে অবস্থিত ২৭ টি কক্ষকে মন্দির বানিয়ে ফের নতুন করে নির্মাণের দাবি জানিয়েছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। 

প্রসঙ্গত, এবার কুতুব মিনারের চত্বরে মন্দির পুনরুদ্ধার সম্পর্কিত মামলায় স্থগিতাদেশ দিয়ে দিল দিল্লি হাইকোর্ট। কুতুব উল ইসলাম মসজিদে ২৭ টি হিন্দু মন্দির এবং জৈন মন্দিরের দাবি জানিয়ে এই মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কুনওয়ার মহেন্দ্র সিং নামক এক ব্যক্তি নিজেকে রাজ পরিবারের বংশধর বলে দাবি করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, দক্ষিণ দিল্লির অধিকার তাঁরই। তিনি অভিযোগ করেছেন, এতদিন ধরে দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশ সরকার কোনও আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই তার অধিকার হরণ করেছে। 

১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক কুতুবউদ্দিন আইবকের নির্দেশে কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। দিল্লির কুতুব কমপ্লেক্সে অবস্থিত এই মিনারটি বিশ্বের মধ্যে ইটের তৈরি সর্বোচ্চ মিনার। এর দৈর্ঘ্য ৭২.৫ মিটার। মিনারটিতে ৩৭৯ টি ঘোরানো সিঁড়ি রয়েছে। কুতুব মিনারের দক্ষিণ পশ্চিম থেকে ২৫ ইঞ্চি একটি ঢাল আছে যা নিরাপদ সীমা হিসেবে বিবেচিত হয়। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পলের মতে, কুতুব মিনার ছিল ‘দাম্ভিক এবং জয়োল্লাসপূর্ণ একটি বার্তা’।

পুরাতত্ত্ববিদরা এই মিনার কমপ্লেক্সটির প্রকৃত হালহকিকত নিয়ে রীতিমতো ওয়াকিবহাল। ভারতের প্রশাসনিক আইন অনুযায়ী, এটি একটি সংরক্ষিত স্থাপনা। তাদের ধারণা, এর বৈশিষ্ট্য চিরস্থায়ী এবং এর পরিবর্তনের কোনও সুযোগ নেই। আজকের দিনে কুতুব মিনার স্রেফ একটি মিনার নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। যেমন, দীর্ঘকাল ধরে যারা দিল্লির অধিবাসী, তাদের স্মৃতিতে কুতুব মিনার একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। 

এদিকে, ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই একে একে মুসলিমদের ইতিহাস ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত সমস্ত স্থাপনার নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে। এখন কুতুব মিনারের নাম বদলে ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’ রাখতে হবে বলে দাবি গেরুয়া শিবিরের। অন্যদিকে, মুসলিম সম্রাট শাহজাহানের তৈরি তাজমহল কোনও দিন ‘তেজো মহালয়া’ নামের একটি মন্দির ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখবার কাজের আবেদন জানিয়েছে বিজেপি সরকার। 

দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি এই কুতুব মিনার নিয়ে বিতর্ক কিন্তু আজকের নয়। এর আগেও কুতুব মিনারকে ঘিরে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল দিল্লির সাকেত আদালতে। তাতেও এটিকে মন্দির হিসেবে পুনর্নির্মাণ করার আবেদন জানানো হয়েছিল। 

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close