গত কয়েকদিন যাবৎ ভারতের সবচেয়ে ধনী রাজ্য মহারাষ্ট্রের রাজ্য সরকার নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে চারিদিকে। রীতিমতো ঘোর সংকটেই রয়েছে সেখানকার সরকার। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের জেরে উত্তাল সেখানকার রাজ্য-রাজনীতি। গত বুধবারই শিবসেনা সাংসদ সঞ্জয় রাউতের বক্তব্যে নড়েচড়ে বসেছিল সকলে। তাঁর বক্তব্যে অনুমান করা হয়, সরকার বাঁচানোর স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে পারেন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে। এবং সে ব্যাপারে সম্মতিও প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
এদিকে, গতকালই জানা গিয়েছে শিবসেনা সুপ্রিমো তথা মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এমতাবস্থায় তো তাঁর আইসোলেশনে থাকা উচিত। কিন্তু, সেখানকার উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির জেরে বাধ্য হয়ে তিনি তাঁর সরকার বাসভবন ‘বর্ষা’ ত্যাগ করেন এবং নিজ বাসভবন ‘মাতোশ্রী‘-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছেলে তথা রাজ্যের মন্ত্রী আদিত্য ঠাকরে।
উল্লেখ্য, বুধবার সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি ইস্তফা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমি বালা সাহেবের ছেলে, আমি কোনও পদের পিছনে ছুটে বেড়াই না। পদ তো আসবে, যাবে। কিন্তু, আসল সম্পদ তো হল মানুষের ভালোবাসা। গত দু বছরে আমি যথেষ্ট স্নেহ পেয়েছি তাঁদের থেকে। মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে আমি নিজ বাসভবনে ফিরে যাব। কিন্তু, আপনারা কি আমায় কথা দিতে পারবেন, পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী শিবসেনা থেকেই নির্বাচিত হবেন!” এদিকে এদিন মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছাড়ার পরই জল্পনা শুরু হয়ে যায়, উদ্ধব কি তবে আর মুখ্যমন্ত্রী থাকছেন না! সেই জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে শিবসেনা মুখপাত্র সঞ্জয় রাউত জানান, “উদ্ধবই আপাতত মুখ্যমন্ত্রী পদে বহাল থাকছেন। এখনই তিনি ইস্তফা দেবেন না। প্রয়োজন হলে তিনি বিধানসভায় শক্তিপরীক্ষা দেবেন।”
অপরদিকে, গতকাল অর্থাৎ বৃহস্পতিবার শিন্ডে গোষ্ঠীর আরও কিছুটা পাল্লা ভারী হল। এবার প্রশ্ন হচ্ছে কে এই শিন্ডে? একনাথ শিন্ডে হলেন মহারাষ্ট্রের শিবসেনার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা তথা নগরোন্নয়ন মন্ত্রী। আর শিবসেনা হল মহারাষ্ট্রকেন্দ্রিক একটি ডানপন্থী মারাঠি হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল। গত ১৯৬৬ সালে কার্টুনিস্ট বাল ঠাকরে এই দলের সূচনা করেন। বর্তমানে, একনাথ শিন্ডে আসা মে বসেই এই দলের পরিচালনা করছেন। এই একনাথ শিন্ডে রাজ্য রাজনীতির খেলা পরিবর্তন করে দিতে পারেন, এমনই একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
বিশেষত, থানে অঞ্চলে সেনাদের শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এই শিন্ডে। এর আগে একাধিকবার তিনি সেনার প্রধান রাজনৈতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করবার দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০০৪, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে অর্থাৎ পরপর চার বার মহারাষ্ট্র বিধানসভায় তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। উল্লেখ্য, তিনটি রাজনৈতিক দলের জোটের ফলে তৈরি হয়েছিল মহা বিকাশ আগাড়ি সরকার। কিন্তু, বর্তমানে শিবসেনার অন্দরে যে দ্বন্দ্ব চলছে তার জেরে এই জোট দলও প্রায় ভাঙতে বসেছে৷ উল্লেখ্য, ২২ জুন বুধবার সকালে নিজের দলবল নিয়ে গুয়াহাটি পৌঁছে যান শিন্ডে। সেখানে পৌঁছে তিনি দাবি করেন, তাঁর সঙ্গে ৪০ জন বিধায়ক রয়েছেন।
এদিকে এদিন মহারাষ্ট্রের আগাড়ি জোট পতনের জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে শিবসেনা মুখপাত্র সঞ্জয় রাউত বলেন, “আমরা কিছু বিধায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। বিজেপি মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানের মতো চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু, তাতে কোনও লাভ হবে না। খেলাটা এত সোজা নয়। শিন্ডের মাধ্যমে মহারাষ্ট্র সরকারের পতন ঘটবে না। তিনি তো একজন দলের অন্তঃপ্রাণ কর্মী। রাজ্যের পুর নির্বাচনের আগে সরকার ফেলে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে।”
তবে অনুমান করা হচ্ছে, একনাথ শিন্ডের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে রাজ্যপালের কাছে নিজের সংখ্যার জোর প্রদর্শন। ইতিমধ্যেই রাজ্যপালের কাছে সময় চেয়েছেন শিন্ডে। তাঁর দাবি দলের দুই তৃতীয়াংশ সমর্থন তিনি দেখাতে পারবেন। এরপরেই রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরেকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করার কথা বলতে পারেন। যদি মুখ্যমন্ত্রী সেই কাজে ব্যর্থ হন তাহলে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করে ফেলতে পারেন শিন্ডে।
এখানে একটা প্রশ্ন, যিনি শিবসেনার এমন একজন একনিষ্ঠ কর্মী এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতা, তিনি হঠাৎ শিবসেনার প্রতি এমন বিক্ষোভ প্রকাশ করলেন কেন? খবর সূত্রে জানা গিয়েছে, কংগ্রেস এনসিপি-র (NCP) সঙ্গে যতটা ঘনিষ্ঠ হয়েছে ততটাই দলে এক কোণে পড়ে গিয়েছেন একনাথ শিন্ডে। তাঁকে সাইডলাইন করা হচ্ছে বলে এর আগে তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে অভিযোগও করেছিলেন। এই ঘটনার পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তাঁর অনুগামী বিধায়কদের সঙ্গে নিয়ে গুজরাট যাওয়ার পরিকল্পনা করবেন।
এদিকে মহারাষ্ট্রের এনসিপি দলের প্রধান শরদ পাওয়ার স্পষ্টতই জানিয়েছেন, “আগাড়ি সরকার সমস্যামুক্ত হবে খুব শীঘ্রই। আমি আমার এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি বলতে পারি এক্ষেত্রে উদ্ধবই জয়ী হবেন। সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে কিনা, তা তো নির্ধারণ করা হবে বিধানসভায়। আমার বিশ্বাস, আগামীতে বিধানসভায় যখন আস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হবে, তখন উদ্ধবের জয় নিশ্চিত। একবার যদি শিবসেনার বিধায়করা ফিরে আসেন তাহলেই পুরো ছবিটা বদলে যাবে।”
আসলে আগাড়ি সরকারে চিন্তার মেঘ জমার কারণ হল, শিবসেনার মাত্র ১৩ জন বিধায়ক উদ্ধবের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বাদবাকিরা সকলেই এখন আসামে। তাঁদের কথাতে বোঝাই যাচ্ছে আগাড়ি সরকারের সঙ্গে তাঁরা আর থাকতে চাইছেন না। তাঁরা এখন বিজেপির সঙ্গেই হাত মেলাবেন। ইতিমধ্যেই বিজেপি সরকার একনাথ শিন্ডেকে উপ-মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসানোর প্রস্তাব পেশ করেছে৷ এর আগে, অজিত পাওয়ারকে এই পদের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। শোনা যাচ্ছে, নতুন সরকার যদি গঠন হয় তবে শিন্ডের গোষ্ঠীকে বিজেপি সরকার ৯টি মন্ত্রক প্রদান করতে পারে।
প্রসঙ্গত, মহারাষ্ট্রে বর্তমানে ২৮৭ আসনের বিধানসভায় বিজেপি আইনপ্রণেতার সংখ্যা ১১৩ জন। এখন বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে এবং সরকার গঠন করতে তাদের ১৪৫ জনের আসন। এবার মহারাষ্ট্রের এই টালমাটাল পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অবস্থার মধ্যে তিনি টার্গেট করলেন ভারতীয় জনতা পার্টিকেই। ওঁনার বক্তব্য, “গণতন্ত্রকে পুরোপুরি শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। মহারাষ্ট্রে আজ হচ্ছে, কাল অন্য রাজ্যে এই একইভাবে বিজেপি সরকার ফেলবে। এই ঘটনা গণতান্ত্রিক দেশে একেবারেই কাম্য নয়।”