সেই মধ্যযুগে পাখির পালকের নীচের অংশ ফালি করে কেটে তা সামান্য তীক্ষ্ণ করে, তরল কালিতে ডুবিয়ে তা দিয়ে লেখার কাজ চালানো হত। ১৮৮৪ সালে ল্যুইস এডসন ওয়াটারম্যান প্রথম বাণিজ্যিক এবং ব্যবহারিক কাজের জন্য বাজারে নিয়ে এলেন ফাউন্টেন পেন। এই কলম বা পেন সম্পর্কে একটি পুরোনো প্রবাদ রয়েছে, ‘কালি, কলম, মন লেখে তিনজন’। এই পেন অনেকের কাছেই শুধু একটা নির্জীব বস্তু নয়, অনেকের কাছেই এ এক বিশেষ আবেগের এবং শৌখিনতার জিনিস। তবে, দামি ফাউন্টেন পেনের ক্ষেত্রে এক সমস্যা হল, একবার যদি তা খারাপ হয় তাকে সারিয়ে তোলা দুষ্কর হয়ে পড়ে।
জড় বস্তু হলে কি হবে! পেনেরও তো বয়স বাড়ে, তার চেহারাতেও বয়সের ছাপ পড়ে, কালি শুকিয়ে অকেজো হয়ে যায়, বা বিরল কোনও সমস্যাও হতে পারে তার। তো কলম বিলাসী বা পেনপ্রেমীদের এই প্রিয় পেনের অসুখ সারানোর উপায় কি? উপায় রয়েছে খাস কলকাতা শহরের বুকে। পেনের হাসপাতাল (Pen Hospital)! এ সত্যিই এক আশ্চর্যজনক ব্যাপার। সেখানকার সত্তরোর্ধ্ব মহম্মদ ইমতিয়াজ পেন হাসপাতালের একমাত্র চিকিৎসক।
গত তিন প্রজন্ম ধরেই তাঁরা পুরোনো, অকেজো হয়ে যাওয়া পেনের চিকিৎসা করে আসছেন। জানা যায়, ১৯৪৫ সালে এই ‘পেন হসপিটাল’ তৈরি করেন ইমতিয়াজের দাদু সামসুদ্দিন। দাদুর মৃত্যুর পর বাবা মহম্মদ সুলতানের হাত ধরে ইমতিয়াজ এবং তাঁর ভাই মহম্মদ রিয়াজ এই ধারা বজায় রেখেছেন। কলকাতার ধর্মতলা মেট্রো স্টেশনের ৪ নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে ফুটপাতের বাঁ দিকেই ঝোলানো রয়েছে তাঁদের ‘পেন হসপিটাল’-এর বোর্ড। সেখানে সরু গলির একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই প্রবীণ হসপিটাল।
এই হসপিটালে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা জানেন এই শহরে কতরকমের বিচিত্র কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে। হসপিটালের কাঁচের আলমারিতে সারি সারি দাঁড় করানো রয়েছে অসুস্থ সব কলমদের। তাদের কারও রয়েছে জটিল সমস্যা, কারও বা হালকা সমস্যা রয়েছে যা অল্প চিকিৎসাতেই সেরে যাবে। কারও হয়তো কালি শুকিয়ে গিয়েছে, কারও নিব ভাঙা, কোনওটার আবার চ্যানেল নষ্ট, আবার কারও মাথা এমন জ্যাম হয়েছে যা খোলাই যাচ্ছে না। তো এইসব অসুখের চিকিৎসার জন্য ইমতিয়াজ বাবুদের কাছে রয়েছে একাধিক যন্ত্রপাতি। আবার কোনওটার রোগের ওষুধ তাদের কাছে নেই, তা আনাতে হয় বাইরে থেকে।
পেন চিকিৎসক ইমতিয়াজ বাবু বলেন, “আমার এই কাজ শেখা বাবার কাছেই। বাবা চলে যাওয়ার পর আমি আর ভাই এর দেখাশোনা করছি। তবে, বাবা থাকাকালীন আমার অন্য একটি ব্যবসাও ছিল, সেই কারণে এখানে খুব একটা সময় দিতে পারতাম না। ছোট ভাই রিয়াজও হঠাৎ চলে গেল, তারপর থেকে আমিই দোকানের হাল ধরেছি। কলকাতার পেন উৎসবেও আমরা অংশগ্রহণ করে থাকি। শুধুমাত্র পেনের রোগ সারানোই নয়, পুরোনো দুষ্প্রাপ্য পেন সংগ্রহ করে রাখাও আমাদের কাজ।”
তাঁর কথায়, “এখনকার প্রজন্ম তো কালি কলম দিয়ে তেমন লেখে না, কতশত আধুনিক পেন এসে গিয়েছে বাজারে। আমার বাপ ঠাকুরদার আমলে দেখেছি বিদেশ থেকে ফাউন্টেন পেন নিয়ে আসা হত। শেফার্ড, ওয়াটারম্যান, পিয়ার কারদা, পার্কার, পাইলট, ভিসকন্টি, মঁ ব্লাঁ, পেলিকান, অরোরা, সেইলর, উইলসনের মতো রয়্যাল সব পেন ছিল দোকানে। সেসব পেন একবার খারাপ হলে, তা সারাই করার জন্য তাঁরা ছুটে আসতেন এই পেন হসপিটালে। সেসময় দোকানের নাম ছিল অন্য ‘সেল অ্যান্ড সার্ভিস’। পরে পেন হসপিটাল নাম রাখা হয়, মানুষের চিকিৎসার জন্য যেমন হসপিটাল তেমনি পেনের চিকিৎসার জন্য এই পেন হসপিটাল।”
“এখনও বহু মানুষ আছেন যাঁরা কালিতে কলম ডুবিয়ে লিখতে ভালোবাসেন। বা পুরোনো কলম সংগ্রহ করতে ভালোবাসেন কিংবা প্রিয়জনকে উপহার হিসেবে কলম দিতে পছন্দ করেন, তাঁদের মতো মানুষদের জন্যই আমাদের পেন হসপিটাল টিকে আছে। আমার ঠাকুরদার আমলে কলকাতা শহরে পেন মেরামতের আরও দোকান ছিল। বর্তমানে সেগুলো বিলুপ্তপ্রায়। আমরাই এখনও তিন পুরুষ ধরে কাজ করছি। অনেক খদ্দেরই যারা আমার দাদুর আমলে দোকানে আসতেন, এখন তাদেরই নাতি নাতনিরা আমার কাছে আসে। দেখে ভালো লাগে।” বলেন ইমতিয়াজ বাবু।
উল্লেখ্য, পেন হসপিটালে শুধু পেন মেরামতিই নয়, পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশি, বিদেশি, বিরল সংগ্রহের পেন। তিরিশ, চল্লিশ কিংবা ষাটের দশকে যে পেনের দাম ছিল ১০০-২০০ টাকা, আজ সেই পেনের দাম হয়ে গিয়েছে ২০০০-৩০০০ টাকা বা তারও বেশি। রয়েছে পেনের বিভিন্নরকম পার্টস। ইমতিয়াজের দাদুর আমলে এই হসপিটালে পেন সারাতে ছুটে গিয়েছেন তৎকালীন বিখ্যাত সব লেখক, অধ্যাপক এবং সাংবাদিকেরা। এখন ইমতিয়াজ বাবুকে অনেকেই ফোন করে পেনের রোগের কথা জানান। রুগী পেনদের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজেই ছুটে যান রোগীর বাড়িতে।
আসলে, তিন প্রজন্মের এই ব্যবসার প্রতি ইমতিয়াজ বাবুর ভালোবাসা আজও একই রয়ে গেছে। এই প্রজন্ম কালি কলমের প্রতি তেমন আকর্ষণ অনুভব না করলেও, ব্যবসা তুলে দেওয়ার কথা ভাবেননি তিনি। যে গুটিকয়েক মানুষ পেনের কদর করেন, মর্যাদা দেন, যত্ন করে গুছিয়ে রাখেন প্রিয় কলমদের, তাঁদের কাছে কলকাতার এই ‘পেন হসপিটাল’ আজও প্রিয় গন্তব্য।