কোভিডের চোখ রাঙানি মিটতে না মিটতেই, শুরু হল মাংকিপক্সের আতঙ্ক। এবার এরই মধ্যে ফের ধেয়ে এল পোলিও রোগের ভাইরাস। ২০১১ সালেই প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল পোলিওর আতঙ্ক। এবার ফের নতুন করে তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল খাস কলকাতার বুকে। উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র তরফ থেকে ২০১৪ সালেই ভারতকে পোলিও মুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তারপরে সত্যিই আর পোলিওয় আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি দেশে। এত বছর পর আবার পোলিও নতুন করে ছড়াল কেন? তাও আবার কলকাতা শহরে?
উল্লেখ্য, সম্প্রতি কলকাতার মেটিয়াবুরুজ এলাকার এক নর্দমায় প্রথম পোলিওর জীবাণুর সন্ধান মেলে। স্বভাবতই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এলাকা জুড়ে। কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর বোরো অর্থাৎ মেটিয়াবুরুজের ওই নর্দমায় গত মে মাসের শেষের দিকে পোলিওর জীবাণুর সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই স্বাস্থ্য দফতর থেকে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর কর্তৃক জানানো হয়েছে, বিশেষ করে শিশুদের সাবধানে রাখতে হবে। যেসব শিশুরা একটুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে অর্থাৎ যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, সেই শিশুদের জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নিয়ম করে পোলিওর টীকা গ্রহণ করতে হবে।
নতুন করে ফের পোলিওর দাপট শুরু হওয়ায় কার্যতই উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছেন কলকাতাবাসীরা। আট থেকে আশি সকলেরই মনে আতঙ্কের বাসা বেঁধেছে। পোলিওর প্রাথমিক লক্ষণ হল পেট খারাপ। যেসব রোগীরা পেটজনিত সমস্যা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন, তাদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকদের বক্তব্য, কেউ যেনও খোলা জায়গায় শৌচ কর্ম না করেন। এর জেরে পোলিওর জীবাণু মারাত্মক হারে ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে।
মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচ এলাকায় এমনই একাধিক খোলা জায়গা রয়েছে। সেসব জায়গায় যাতে আর কেউ শৌচ কর্ম না করেন, তার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া উচিত প্রশাসনের। জানা গিয়েছে, পোলিওর জীবাণু ভিভিপভি টাইপ ওয়ানের সন্ধান মিলেছে এবার। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, নর্দমার ওই জলে কোনও পোলিও রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মল থেকে জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে। আর নয়তো, লাইভ পোলিও ভ্যাকসিন নিয়েছে এমন কোনও শিশুর মল থেকেও এর ভাইরাস ছড়িয়ে থাকতে পারে।
পোলিও আসলে কেমন ধরনের রোগ এক্ষেত্রে তা জেনে রাখাটা দরকার সকলেরই। পোলিও বা পোলিওমাইলিটিজ মূলত এক ধরনের ভাইরাসঘটিত সংক্রামক রোগ। যা আরএনএ (RNA) পরিবারের একটি ভাইরাস। এটি সাধারণত ৫ বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। আক্রান্ত রোগীর শরীরের কোনও বিশেষ অংশ পঙ্গু হয়ে যেতে পারে কিংবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হতে পারে। এই ভাইরাস স্নায়ুতন্ত্রকে একেবারে কমজোরি করে দেয়। বিশেষত এই রোগের আক্রান্ত স্থান পা। এক্ষেত্রে কোনও কোনও রোগীর শ্বাস প্রশ্বাসের পেশী একেবারে অবশ হয়ে যায় এবং এর জেরে ওই রোগীর মৃত্য পর্যন্ত ঘটতে পারে। এর জন্যেই পোলিওর টীকাপ্রদান কর্মসূচি আরম্ভ করা হয়।
এর আগে ২০১১ সালে এ রাজ্যের হাওড়া জেলায় দু বছরের এক শিশু কন্যার শরীরে পোলিওর জীবাণুর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এটাই শেষ, তারপর আর পোলিও বিস্তার ঘটায়নি এ রাজ্যে তথা দেশে। এবার ফের পোলিওর জীবাণুর সন্ধান মেলায় গত ২৬ মে ইউনিসেফ (UNICEF) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিনিধিরা মিলে স্বাস্থ্য ভবনে একটি জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে সম্প্রতি কেউ পোলিওর টীকা গ্রহণ করেছেন কিনা সে বিষয় খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে। রাজ্যে যতগুলি মেডিক্যাল কলেজ এবং সরকারি হাসপাতাল রয়েছে সেগুলির বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার কথা ঘোষণা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, পোলিও নতুন রোগ নয়। এর বিরুদ্ধে লড়াইটাও নতুন নয়। ১৯৫০ সাল থেকে পোলিও দমনের লড়াই চলে আসছে। সেসময় আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গের বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ডঃ জোনাস এডওয়ার্ড স্যাকের তৈরি প্রথম ইনঅ্যাক্টিভেটেড পোলিও ভ্যাকসিন অর্থাৎ IPV পোলিও রোগ নিয়ন্ত্রণের অনুমতি লাভ করে। এরপর দীর্ঘ ৩৮ বছর পর পোলিওর ভ্যাকসিন যথাযথ প্রয়োগের ফলে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ কমেছে। এরপর পোলিও ভ্যাকসিন ব্যবহার কর্মসূচি যাতে আর গ্রহণ না করতে হয় তার জন্য ‘দ্য এন্ড গেম‘ স্ট্র্যাটেজি শুরু করা হয়।
৬০-এর দশকের শুরুর দিকে পোলিশ আমেরিকান বিজ্ঞানী ডঃ অ্যালবার্ট বি. সেবিন সিনসিনাটির চিলড্রেন হসপিটাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন থেকে গবেষণা করে আবিষ্কার করলেন পোলিওর লাইভ অ্যাটিন্যুয়েটেড ভ্যাকসিন। এতে আইপিভি-র থেকে অনেক ভালো ফল পাওয়া গেল। এই দুই আইপিভি এবং ওপিভি আবিষ্কারের পর সারা বিশ্ব জুড়ে পোলিওর জীবাণু নিশ্চিহ্ন করবার জন্য একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
সূত্রের খবর, এর আগে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে আফ্রিকার মালাউই দেশের রাজধানী লিলংওয়েতে একটি শিশুর শরীরে পোলিওর ভাইরাস মেলে। শিশুটির শরীরে পোলিওর যে স্ট্রেন পাওয়া গিয়েছিল তা সম্ভবত পাকিস্তান থেকে এসেছে বলে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেছিল।
দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করার এত বছর পরে ফের কেন পোলিও থাবা বসাল এ নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিশ্বের সমস্ত দেশের পরিচালন ব্যবস্থা এবং প্রত্যেকটি সাধারণ মানুষের সমষ্টিগত লড়াইয়ের ফলে পোলিওর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল দেশবাসী। যা অত্যন্ত গর্বের। কিন্তু, ফের কেন পোলিও চোখ রাঙাচ্ছে? তাহলে কি বলা যায়, পোলিও সম্পর্কে রাজ্যের মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব দেখা দিচ্ছে! যেহেতু দেশ পোলিওমুক্ত তাই পোলিওকে গ্রাহ্য করছেন না কেউ! রোগের সচেতনতা বৃদ্ধি, নিজেকে এবং আশেপাশের মানুষকে সুস্থ রাখবার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে প্রত্যেককে। অযথা রোগকে নিয়ে ভয় পেয়েও কোনও লাভ নেই। বরং রোগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সাধারণ মানুষকে। কোনওভাবেই রোগ এড়িয়ে গেলে চলবে না। তাহলেই ফের আগের মতো পোলিওমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে।