স্বপ্নদ্বীপের মৃত্যুতে কি র্যাগিং-এর বিষয়টিই প্রাধান্য পেতে চলেছে ? পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার বাসিন্দা সৌরভ চৌধুরীকে শুক্রবার গভীররাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এঘটনার পর রীতিমতো নড়েচড়ে বসেছেন বিদ্যার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবক মহল।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার স্বপ্নদীপের বাবা রামপ্রসাদ কুণ্ডু-র লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে সৌরভ চৌধুরী নামে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সৌরভ চৌধুরী পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসিন্দা এবং এমএসসি-র প্রাক্তনী। সেই অভিযোগপত্রে সৌরভ চৌধুরীকে ঠান্ডা মাথার খুনি হিসেবে তার ছেলের খুনি হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন।সঙ্গে লিখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সৌরভ চৌধুরী সম্পর্কে কিছু কথা। পুলিশের কাছে জমা দেওয়া সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই যাদবপুরের প্রাক্তনী এবং হস্টেলের আবাসিক সৌরভকে গ্রেফতার করেছে যাদবপুর থানার পুলিশ। একটি চায়ের টেবিলে সৌরভ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ হয় নদিয়ার বগুলার বাসিন্দা সপ্নদ্বীপ কুন্ডুর। স্বপ্নদ্বীপের বাবা রমাপ্রসাদ কুণ্ডুকে সৌরভ বলেছিলেন- সপ্নদ্বীপ ভাল থাকবে। এরপর স্বপ্নদ্বীপকে দেখে রাখার জন্য সৌরভের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন রামপ্রসাদ। সেই রক্ষকের ভূমিকা অর্পণ করাই নাকি কাল হয়েছে স্বপ্নদ্বীপের, বিড় বিড় করে বলছিলেন, রমাপ্রসাদ।
পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগে রামপ্রসাদ জানিয়েছেন, তাঁর দুই পুত্র। স্বপ্নদীপ এবং রত্নদীপ কুণ্ডু। বড় ছেলে উচ্চমাধ্যমিকের পর গত ৩ অগস্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে স্নাতক স্তরে ভর্তি হয়। প্রথমে স্বপ্নদীপ বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে থাকার সুযোগ পায়নি বলেও অভিযোগপত্রে জানান রামপ্রসাদ। পুলিশকে তিনি আরও জানিয়েছেন, গত ৩ অগস্ট যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে একটি চায়ের দোকানে তাঁর সঙ্গে সৌরভের আলাপ। আবাসিক না হয়েও ‘গেস্ট’ হিসাবে হস্টেলে যে থাকা যায়, সে কথা তিনি সৌরভের মাধ্যমে জানতে পারেন বলে দাবি করেছেন রামপ্রসাদ। তাঁর দাবি, সৌরভই মনোতোষ নামে আরও এক ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন স্বপ্নদীপের। মনোতোষ থাকেন ১০৪ নম্বর রুমে। স্বপ্নদীপের থাকার ব্যবস্থা হয় ৬৮ নম্বর রুমে। রামপ্রসাদ অভিযোগপত্রে লিখেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়েরই দুই ছাত্র সৌরভ চৌধুরী (প্রাক্তন) এবং মনোতোষ মণ্ডল (সোশিওলজি, দ্বিতীয় বর্ষ)-এর মাধ্যমে আমার ছেলে হস্টেলের ৬৮ নম্বর ঘরে থাকার সুযোগ পায়। ঘরটি এ-২ ব্লকের তিন তলায়। ৬ অগস্ট থেকে ছেলে হস্টেলে থাকা শুরু করে।”
মৃত ছাত্রের বাবা অভিযোগ করেছেন, শেষ বার স্বপ্নদীপ মাকে ফোন করে কেঁদে ফেলেছিলেন। পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছেন স্বপ্নদীপের বাবা রামপ্রসাদ। স্বপ্নদীপের বাবা অভিযোগপত্রে লিখেছেন, ‘‘আমার ছেলে গত রবিবার ৪ অগস্ট থেকে হস্টেলে থাকা শুরু করে। এর পর আমার সঙ্গে ওর ফোনে কথা হয়। ও খুব চাপে আছে। এখন বলতে পারবে না। বাড়ি গিয়ে বলবে। এর পর বুধবার (৭ অগস্ট) রাত সাড়ে ৮টা-৯টা নাগাদ স্বপ্নদীপ আমাকে ফোন করে বলে, ‘আমার খুব ভয় করছে। আমাকে হস্টেল থেকে এখনই নিয়ে যাও।’ এর পর ওর সঙ্গে ফোনে কথা হয়নি।’’ অভিযোগপত্রে স্বপ্নদীপের বাবা উল্লেখ করেছেন, ‘‘অন্যদের ফোন থেকে ফোন করে আমাদের সঙ্গে কথা বলে। ও খুব অস্থির ছিল। আমার স্ত্রী-র সঙ্গে ছেলের কথা হয়। ছেলে মাকে বলে যে, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। তখন ছেলে খুবই আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় ছিল এবং ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। তার পর রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ আমার স্ত্রী-কে ওখান থেকে এক জন ফোন করে জানায় যে, আমার ছেলে উপর থেকে পড়ে গিয়েছে। তার পর আমার ছেলে মারা যায়।’’
অভিযোগপত্রের শেষে যাদবপুরের প্রাক্তনী সৌরভের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন স্বপ্নদীপের বাবা। লিখেছেন, ‘‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সৌরভের নেতৃত্বে হস্টেলের অন্য ছেলেরা আমার বড় ছেলেকে অত্যাচার করে হস্টেলের উপর থেকে নীচে ফেলে মেরে দেয়। আমি ওদের বিরুদ্ধে আইনত কঠোর ব্যবস্থা চাই।’’ইতিমধ্যে এই ঘটনায় খুনের মামলা রুজু করেছে পুলিশ। সম্মিলিত অপরাধের ধারাতেও মামলা হয়েছে। সৌরভকে শনিবার আলিপুর আদালতে হাজির করানো হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের এ-২ ব্লকে থাকা বেশ কয়েক জন আবাসিককে জিজ্ঞাসাবাদও করছে পুলিশ।
শুক্রবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত জানান, বুধবার রাত ১০টা ৫ মিনিটে এক পড়ুয়ার কাছ থেকে ফোনে তিনি শুনেছিলেন যে, এক ছাত্রের ‘পলিটিসাইজ়েশন’ হয়েছে। ‘পলিটিসাইজ়েশন’ শব্দের অর্থ তাঁর কাছে অজানা ছিল। তিনি ওই পড়ুয়ার কাছে ওই শব্দের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে ওই পড়ুয়া নাকি তাঁকে জানান, এক ছাত্রকে ক্যাম্পাসে বলা হয়েছে হস্টেলে না থাকতে। কারণ, সেখান থেকে নাকি দোতলা, তিন তলা থেকে ঝাঁপ দিতে হয়। রজতের সেই কথা প্রকাশ্যে আসার পর স্বপ্নদীপের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা আরও প্রলম্ভিত হয়েছে। রজত জানান, ওই পড়ুয়াকে বিষয়টি হস্টেলের সুপারকে জানাতে বলেন তিনি। কারণ, ক্যাম্পাসে সুপার থাকেন। সেই সময় তিনি নিজে নৈশভোজ সারছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাত ১০টা ৮ মিনিটে খেতে খেতেই সুপারকে ফোন করি। যে পড়ুয়া ফোন করেছিল, ফোনের ‘ট্রুকলার’ মারফত তার নাম সুপারকে জানাই। তাকে চেনেন কি না জিজ্ঞাসা করি। উনি চেনেন বলায় ওঁকে বলি একটা সমস্যা হয়েছে এ-২ ব্লকে। আপনি দেখুন। আমায় রিপোর্ট দেবেন।’’ কিন্তু তার পর আর কোনও ফোন পাননি বলে দাবি করেছেন ডিন অফ স্টুডেন্টস। রাত ১২টা নাগাদ সুপারের কাছ থেকে তিনি ফোন পান বলে দাবি করেন। ওই ফোনেই ডিন অফ স্টুডেন্টসকে সুপার জানান, এক পড়ুয়া পড়ে গিয়েছে। ওই ছাত্রকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর কথা বলেন ডিন অফ স্টুডেন্টস। তিনি নিজেও রওনা দেন। উপাচার্যের নির্দেশ মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-১, এ-২ ব্লকের হস্টেলে প্রথম বর্ষের যত পড়ুয়া রয়েছেন, তাঁদের নিউ বয়েজ় হস্টেলে স্থানান্তরিত করা হয়েছে বলে জানান ডিন অফ স্টুডেন্টস। ওই হস্টেলগুলি যে সব ছাত্রের জন্য বরাদ্দ নয়, সে রকম অনেক ‘পাশ আউট’ পড়ুয়াও মেন হস্টেলে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। পাশ করার পরও কী ভাবে হস্টেলে থাকছেন ওই পড়ুয়ারা? এই প্রসঙ্গে ডিন অফ স্টুডেন্টস বলেন, ‘‘এটা উপাচার্যকে জিজ্ঞাসা করবেন। রেজিস্ট্রারকে জিজ্ঞাসা করবেন। প্রাক্তনীদের অবিলম্বে হস্টেল ছাড়তে নোটিস জারি করা হয়েছে।’’
তবে র্যাগিং কাণ্ডের বিষয়টি যে, গোটা রাজ্যবাসী সমূলে উৎপাটিত করতে চান তা একরকম পরিষ্কার।
কলকাতা থেকে নিজস্ব প্রতিনিধির রিপোর্ট, টাইমস ফোর্টিন বাংলা।