শনিবারের বিকেল : 07 Jan, 2022

আরও পড়ুন

সংক্ষেপে জানুন স্বামী বিবেকানন্দের জীবন কাহিনী

স্বামী বিবেকানন্দের আসল নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর ডাকনাম ছিল বীরেশ্বর বা বিলে এবং নরেন্দ্র বা নরেন। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের দিন উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা বিশ্বনাথ দত্ত কলকাতা উচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী ছিলেন। বিবেকানন্দ একটি প্রথাগত বাঙালি কায়স্থ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যেখানে তার নয় জন ভাই-বোন ছিল। তাঁর মধ্যম ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও বিদেশ ভ্রমণে বিবেকানন্দের সঙ্গী। কনিষ্ঠ ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট সাম্যবাদী নেতা ও গ্রন্থকার।

ছেলেবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার দিকে বিলের আগ্রহ জেগে উঠেছিল। এই সময় শিব, রাম, সীতা ও মহাবীর হনুমানের মূর্তির সামনে তিনি প্রায়শই ধ্যানে বসতেন। সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতিও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। ছেলেবেলায় বিবেকানন্দ অত্যন্ত দুরন্ত ছিলেন। তার পিতা-মাতার পক্ষে তাকে সামলানো মাঝে মধ্যেই দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে উঠত।

১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে, নরেন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তার পরিবার সাময়িকভাবে রায়পুরে স্থানান্তরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে দত্ত পরিবারে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। নরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনিই ছিলেন সেইবছর উক্ত পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ একমাত্র ছাত্র। তিনি ছেলেবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসেন। দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য বিষয়ে বই পড়ায় তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। বেদ, উপনিষদ্‌, ভাগবদগীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠেও তার আগ্রহ ছিল। এছাড়া তিনি হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতেন এবং নিয়মিত অনুশীলন, খেলাধুলো ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মে অংশ নিতেন।

এরপর তিনি ধীরে ধীরে আধ্যাতিকতার মধ্যে প্রবেশ করতে থাকেন। তিনি ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম রামকৃষ্ণ দেবের সাক্ষাৎ পান। নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কথা প্রথম শোনেন জেনারেল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময়। অধ্যাপক উইলিয়াম হেস্টি একটি সাহিত্যের ক্লাসে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের দ্য এক্সকারশন কবিতাটি পড়ানোর সময় রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কথা বলেছিলেন। উক্ত কবিতায় ব্যবহৃত ‘trance’ কথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ছাত্রদের বলেন, ‘trance’ বিষয়টির সত্যিকারের অর্থ বুঝতে হলে ছাত্রদের দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে দেখতে হবে। এই কথা শুনে নরেন্দ্রনাথ-সহ কয়েকজন ছাত্র রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে, নরেন্দ্রনাথের গুরুভ্রাতা বাবুরামের মা নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের আঁটপুর গ্রামে আমন্ত্রণ জানান। তারা সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করে হুগলি জেলার আঁটপুরে যান এবং কিছুদিন সেখানে থাকেন। আঁটপুরেই বড়দিনের পূর্বসন্ধ্যায় নরেন্দ্রনাথ ও আটজন শিষ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তারা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মতো করে জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। নরেন্দ্রনাথ “স্বামী বিবিদিষানন্দ” নাম গ্রহণ করেন। শিকাগো যাওয়ার পথে তিনি ” বিবেকানন্দ ” ছদ্মনামটি গ্রহণ করেন। পরবর্তী কালে ওই নামটি সর্বাধিক প্রচারিত হয়।

বিবেকানন্দ ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে পরিব্রাজকরূপে রামকৃষ্ণ মঠ ত্যাগ করেন। পরিব্রাজক হিন্দু সন্ন্যাসীর এক ধর্মীয় জীবন– এই জীবনে তিনি স্বাধীনভাবে পর্যটন করে বেড়ান কোনও স্থায়ী বাসস্থান বা বন্ধন ছাড়াই। পরিব্রাজক জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গী ছিল একটি কমণ্ডলু, লাঠি এবং তার প্রিয় দুটি গ্রন্থ – ভাগবদ্গীতা ও ইশানুসরণ। পাঁচ বছর যাবৎ ভারতের সর্বত্র ভ্রমণ করেন বিবেকানন্দ – প্রত্যেক শিক্ষাকেন্দ্র দর্শন করেন এবং বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সুপরিচিত হন সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি তাঁর সহানুভূতি জন্মায় এবং তিনি জাতির উন্নতিকল্পে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় ভিক্ষোপজীবী হয়ে সারা ভারত পদব্রজেই পর্যটন করেন বিবেকানন্দ। সেজন্যেই স্বামীজিকে সারা বিশ্ব ‘পরিব্রাজক’ হিসেবে জানে। কখনো-সখনো তার গুণমুগ্ধেরা তাকে ট্রেনের টিকিট কিনে দিতেন। ভারত পর্যটনের সময় তিনি বিভিন্ন পণ্ডিত, দেওয়ান, রাজা, এবং হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান এমনকি নিম্নবর্গীয় পারিয়া ও সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গেও মেলামেশা ও একত্র বাস করেছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দ শুধুমাত্র একজন সাত্ত্বিক পণ্ডিতই ছিলেন না, বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই বিবেকানন্দ ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাগ্মী ও লেখক। তার অধিকাংশ বই-ই হল বিশ্বের বিভিন্ন শহরে দেওয়া বক্তৃতার সংকলন। তাঁর প্রধান কাজ, রাজযোগ, মূলত তার নিউ ইয়র্কে প্রদত্ত বক্তব্যের আলোচনা নিয়ে গঠিত।

বানহাত্তা অনুসারে, গায়ক, চিত্রশিল্পী, আশ্চর্য ভাষাবিশারদ ও কবি বিবেকানন্দ ছিলেন একজন সম্পূর্ণ শিল্পী। তিনি অনেকগুলি গান ও কবিতা লিখেছিলেন, যার মধ্যে তার প্রিয় রচনা “মৃত্যুরূপা মাতা” কবিতাটি অন্যতম। বিবেকানন্দের উপদেশগুলির মধ্যে রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায় এবং তার ভাষা ছিল সহজ-সাবলীল। বাংলা রচনার ক্ষেত্রে তিনি মনে করতেন, ভাষা এমন হওয়া উচিত যা লেখকের পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের বদলে, লেখকের বক্তব্যের মূল ভাবটিকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে।

‘বর্তমান ভারত’ হল বিবেকানন্দের লেখা একটি বিখ্যাত বাংলা প্রবন্ধ। খ্রিষ্টাব্দের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একমাত্র বাংলা মুখপত্র ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার মার্চ সংখ্যায় এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রবন্ধটি বই আকারে প্রকাশিত হয় এবং পরে ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা’ গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডে সংকলিত হয় এই প্রবন্ধেই বিবেকানন্দ দরিদ্র ও তথাকথিত হীন বর্ণে জন্ম নেওয়া ভারতীয়দের নিজের ভাই বলে উল্লেখ করেছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের ভ্রমণসমূহ, উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতাদান, ব্যক্তিগত আলোচনা এবং চিঠিপত্রের আদান-প্রদান তার স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি হাঁপানি, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য শারীরিক অসুখে ভুগছিলেন। তার দেহত্যাগের কিছুদিন পূর্বে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বর্ষপঞ্জি/পঞ্জিকা পড়তে দেখা যেত। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার তিন দিন পূর্বে তাকে দাহ করার স্থান দেখিয়ে দেন – যে স্থানে বর্তমানে তার স্মৃতিতে একটি মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কতিপয় লোকের কাছে মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচবেন না।

আপনিও হয়ে উঠতে পারেন নামী লেখক। ছোট গল্প, কবিতা, শিক্ষামূলক লেখা পাঠান আমাদের ই-পোর্টালের মেইল আইডিতে। বিভাগীয় সম্পাদক , ’শনিবারের বিকেল’times.14.2020@gmail.com

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close