‘বাঙালিদের রসনা তৃপ্তির আর এক উৎসব পৌষ বা মকর সংক্রান্তি’
পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি হল বাঙালিদের একটি বিশেষ উৎসবের দিন। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। এই দিন বাঙালিরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকেন। তার মধ্যে পিঠে খাওয়া, ঘুড়ি ওড়ানো হল অন্যতম। সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানোর পর সন্ধ্যায় পটকা ফাটিয়ে, ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি করা হয়। ভারতের বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে এই দিনটিকে ঘিরে ঐতিহ্যময় জয়দেব মেলা হয়। বাউল গান এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। মূলত জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি ক্ষণ। ‘মকরসংক্রান্তি’ শব্দটি দিয়ে নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশকে বোঝানো হয়ে থাকে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী ‘সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। ১২টি রাশি অনুযায়ী এরকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মকর সংক্রান্তি বা পৌষসংক্রান্তি-তে মূলত নতুন ফসলের উৎসব ‘পৌষ পার্বণ’ উদযাপিত হয়। নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠে তৈরি করা হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় চালের গুঁড়ো, নারিকেল, দুধ আর খেজুরের গুড়। মকরসংক্রান্তি নতুন ফসলের উৎসব ছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘উত্তরায়ণের সূচনা’ হিসেবে পরিচিত। একে অশুভ সময়ের শেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, পঞ্জিকা মতে, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়। এই দিনে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত সাগরদ্বীপে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে কপিল মুনির আশ্রমকে কেন্দ্র করে পুণ্যস্নান ও বিরাট মেলাও অনুষ্ঠিত হয়। সহস্রাধিক পুণ্যার্থী ও অন্যান্য রাজ্য থেকে আগত দর্শনার্থীদের সমাগম হয় এই মেলায়।
ভারতের উত্তর এবং পশ্চিম প্রদেশগুলিতে উৎসবটি প্রবল আগ্রহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সংক্রান্তি দিবস হিসেবে পালিত হয়। প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও এই দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। তাই সামাজিক এবং ভৌগোলিক গুরুত্ব ছাড়াও এই দিনটি ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে।
পশ্চিম ভারতীয় প্রদেশ গুজরাতে উৎসবটি আরও অনেক বড় আকারে উদযাপিত হয়। মানুষ, সূর্য দেবতার কাছে নিজেদের ইচ্ছেকে সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পালন করে ঘুড়ি উৎসব, যা মূলত প্রিয় দেবতার কাছে পৌঁছনোর জন্য একটি রূপক বা প্রতীক হিসেবে কাজ করে। গ্রামগঞ্জে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে মোরগ লড়াই অনুষ্ঠিত হয়। মকরসংক্রান্তি সম্মান, অভিলাষ এবং জ্ঞানের দেবী সরস্বতীকে সম্মান প্রদানের মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। যেহেতু উৎসবটি শীতের মাঝামাঝি সময়ে উদযাপিত হয়, সেহেতু এই উৎসবে এমন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়, যা শরীরকে উষ্ণ রাখে এবং বেশ শক্তি জোগায়। গুড় দিয়ে তৈরি তিলের লাড্ডু এই উৎসবের অন্যতম উপাদেয় খাবার। মহারাষ্ট্রে একে বলা হয় ‘তিলগুল’। কর্ণাটকে একে বলা হয় ‘ইল্লু বিল্লা’। অন্য কিছু প্রদেশে গবাদিপশুকে নানা রঙে সজ্জিত করা হয় এবং আগুনের ওপর দিয়ে ঝাঁপ দেওয়ানো হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় পৌষ সংক্রান্তি উৎসব। নেপালে এই দিবসটি মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়। অবশ্যিকভাবে দেশ ভেদে এর নামের মতই উৎসবের ধরনে থাকে পার্থক্য।
#অণুগল্প
#সেই_বালাজোড়া
#মালবিকা_মল্লিক
ছোটবেলা থেকেই মাকে আমার একদম ভালো লাগত না। ভীষণ ছোটমনের মানুষ। মা কিন্তু আমাদের সংসারের জন্য প্রাণপাত করতেন। ঠাকুমা ঠাকুরদাকে খুব যত্নআত্তি করতেন। বাবাকেও খুব সমীহ করে চলতেন। কিন্তু তাও মায়ের বেশ কিছু দোষ ছিল। মায়ের গয়নার ওপর সাংঘাতিক লোভ। আমি তখন খুব ছোট, পিসির বিয়ে ঠিক হয়েছিল। দাদু পিসিকে নাকছাবি ছাড়া সোনার কোনও গয়নাই দিতে পারেননি। মাকে দেখে মনে হত, পিসিকে যেন কত ভালোবাসে, কিন্তু আসলে তা নয়। কারণ বাবা, ঠাকুমা পিসিকে দেবেন বলে দুজনেই মায়ের কাছে তার বালাজোড়া চেয়েছিলেন, সেই বালাজোড়া যেটা মায়ের বাবা(দাদু), মাকে বিয়েতে দিয়েছিলেন। মায়ের এক গোঁ, “আমার বাবার এই স্মৃতি আমি কাউকে প্রাণ থাকতে দেব না”। নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসার, সেখানে মায়ের এই গয়নাপ্রীতি খুব দৃষ্টিকটু লাগত। তবে মাকে আমি বালাদুটো কোনদিন পরতে দেখিনি। ট্রাঙ্কে তালাচাবি দিয়ে রাখত। বাবার কারখানাটা যখন বন্ধ হয়ে গেল, তখন আমাদের একবেলা অনশন করতে হত, তাও মা কোনদিন বাবার হাতে তুলে দেয়নি গয়নাটা। বলেনি,” যাও এটা বিক্রি করে কদিনের অন্ন সংস্থান করো”। এতটাই নিষ্ঠুর আমার মা। মায়ের সাথে কথা বলতেও ভালো লাগতনা।
মুখে কিছু না বললেও এড়িয়ে চলতাম মাকে। বাবার কষ্ট দেখে শুধু কষ্টই পেতাম। আর মনে মনে সংকল্প করি যেমন করেই হোক লেখাপড়া শিখে বাবার পাশে দাঁড়াব। এরপর আসে জীবনের চরমতম অন্ধকার দিনটা। বাবা তখন রেলের হকার। হঠাৎ ওনার বিরাট অ্যাক্সিডেন্ট হয়। রেলে দুটো পাই কেটে যায়। গোটা পৃথিবী যেন শূন্য মনে হয়। ঠাকুমা মায়ের কাছে প্রথমে কত অনুনয় বিনয় করেন, তারপর মায়ের গায়ে হাতও তোলেন, বলেন “বালাজোড়া বিক্রি করে স্বামীর প্রাণ বাঁচাও, স্বামীই যদি না থাকল গয়না দিয়ে সঙ সেজে কি করবে?” তাও আমার মা তার জায়গা থেকে একটুও সরে আসেনি।
অ্যাক্সিডেন্টের পর বাবা যেকদিন বেঁচে ছিলেন, সেকটাদিন মা প্রাণপণ বাবার সেবা করেছে, কিন্তু শুধু সেবায় কি আর প্রাণ বাঁচে?? চলে গেলেন বাবা। মা লোকের বাড়িতে বাড়িতে রান্না করে সংসার চালাত। আমি লেখাপড়া শিখলাম। ঠাকুমা, দাদুও গত হয়েছেন ততদিনে।
লেখাপড়া শেষ করে মোটামুটি একটা চাকুরী যোগাড় করলাম। মাকে এসে জানালাম, তার সঙ্গে এক ছাদের তলায় আমার আর থাকার ইচ্ছে নেই। মাকে যে আমি ঘৃণা করি, সেটা মা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারত। যেদিন প্রথম মাসের মাইনে পেলাম, একটা বাড়ি ভাড়া ঠিক করেই বাড়িতে ঢুকলাম। মাকে এসে জানালাম, সে কথা। মা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “তোর নিজের বাড়ি ছেড়ে তুই যাবি কেন, মা? তার চেয়ে ভালো, আমিই না হয় কাল সকালে চলে যাব।” মা আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম, এই বেশ ভালো হল। দুজনে রাতের খাবার খেতে খেতে একটাও কথা বলিনি কেউ কার সঙ্গে। মা নিজের ঘরে চলে গেল। আমি আমার ঘরে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়লাম, পরদিন থেকে ঐ মহিলাকে আর সহ্য করতে হবে না ভেবে, বেশ একটু শান্তিও পেলাম। সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, তখন বেশ কিছুটা বেলা হয়ে গেছে। বিরক্তি লাগল, নতুন চাকুরী, মা চা নিয়ে ঠিক সময় একটু ডেকে দিতেও পারলনা। আলিস্যি ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে মায়ের ঘরের দিকে তাকালাম। ভেজানো দরজা, খুলে দেখে আমার গা হিম হয়ে গেল। মা ফ্যানের আংটায় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। চিৎকার করে লোক জড়ো করতে গেলাম, হঠাৎ নজরে পড়ল খাটের ওপর রাখা একটা চিঠি, আর মায়ের বালাজোড়া রাখা তার ওপরে। বিতৃষ্ণায় বালাদুটোয় হাত দিইনি। আলগোছে চিঠিটা তুলে নিলাম। তাতে লেখা, “উর্মি, আমি জানি তুই আমাকে পছন্দ করিসনা, কেন করিস না, তাও জানি। তুই ভাবিস আমি খুব লোভী আর নিষ্ঠুর। তার মূল কারণ আমার বাবার দেওয়া বালাজোড়া। চরম বিপদের দিনেও এটা আমি যক্ষের ধনের মতো আগলেছি। তাও কারও হাতে এটা তুলে দিইনি। সব সম্পর্কগুলো আমার নষ্ট হয়ে গেছে এক এক করে এটার কারণে। অবশেষে তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলি। তাই আজ আমি নিজেই তোর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। তবে জীবিত অবস্থায় সত্য বহনের যে গুরুভার থাকে, মৃত্যুর পর বোধহয়, সে দায়ভার আর থাকেনা। তাই তোকে সত্যটা জানিয়ে দেওয়াই শ্রেয় মনে করলাম। আমার এই বালাজোড়া নকল। তোর ঠাকুদার কথা অনুযায়ী আমার বাবার সামর্থ্য ছিল না বালা দেওয়া। তাই গিল্টি করা এই বালাদুটি আমার হাতে তুলে দিয়ে আমার কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা অসহায়ের মতো আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন, আমি যেন বাবার লাজ রাখি। আমি আমৃত্যু বাবার লজ্জা ঢেকে রেখেছি। হয়ত আজও রাখতাম। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর, তোর নতুন সংসারে তুই যাতে এগুলো নিয়ে কোন বিপদে না পড়িস, তাই তোকে সবকথা জানালাম। ভালো থাকিস।” জীবনে সেইদিন প্রথম মায়ের জন্য হাউহাউ করে কাঁদলাম।
(শ্রীমতী স্বাতী দের সৌজন্যে)
Courtesy : Biswapati Ray Chaudhuri.