ধনতেরাসের অজানা কাহিনী
ধনতেরাস মূলত অবাঙালিদের একটি উৎসব। যদিও এখন বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই কেনাকাটার উৎসবটি। এই উৎসবে মূলত সোনা, রূপ, বাসনপত্র কেনা হয়। ধোনটেরাসকে অনেক জায়গায় ‘ধনত্রয়োদশী’ নামেও উল্লেখ করা হয়েছে। ‘ধন’ মানে হল সম্পদ আর ‘তেরাস’ হল ত্রয়োদশী তিথি অর্থাৎ আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের তেরোতম দিন হল এই ধনতেরাস। ধনতেরাসের ইতিহাস ঘটলে আমরা দেখবো প্রাচীনকালে রাজা ‘হিম’-এর পুত্র এই ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসেন যে, বিয়ের চতুর্থ দিন রাতে সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হবে। তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী-স্বামীকে বাঁচাতে নিজের যাবতীয় সোনা-রুপোর গয়নামা স্তুপাকারে জোরে করে রাখেন স্বামীর শোয়ার ঘরের দরজায় এবং সমস্ত ঘর প্রদীপের আলোয় সাজিয়ে দেন সাপের পথ আটকাতে।
এরপর তিনি সারারাত গল্প বলে, গান গেয়ে স্বামীকে জাগিয়ে রাখেন। যখন যম সাপের বেশে সেই রাজপুত্রের ঘরে প্রবেশ করতে যান, তার চোখ ধাঁধিয়ে যায় অলঙ্কার ও প্রদীপের ঔজ্জ্বল্যে। ঘরে ঢোকার আগেই বাধা পেয়ে যম ওই সোনার স্তূপের উপর উঠে অন্যপথে প্রবেশ করতে যান। কিন্তু রাজরানীর গল্পে ক্রমশ আকৃষ্ট হয়ে সারারাত সেখানেই কাটিয়ে পরদিন ভোরে নিঃশব্দে ফিরে যান তিনি। যেহেতু সোনার অলঙ্কার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রাজকুমারকে বাঁচায়, তাই এই দিন ধন-সম্পদের আরাধনা করা হয়। এই কারণে ধনতেরাস উপলক্ষ্যে সোনা কেনার বিশেষ প্রবণতা দেশ জুড়ে দেখা যায়। এছাড়াও কেউ কেউ বলেন, একসময় দুর্বাশা মুনির অভিশাপে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হন লক্ষ্মী। রাক্ষসদের সঙ্গে লড়াই করে ধনতেরাসের দিনেই দেবতারা ফিরে পান দেবী লক্ষ্মীকে। হারিয়ে যাওয়া লক্ষ্মীকে ফেরানোর উৎসব হল ধনতেরাস। আবার পুরাণে বলা হয়েছে যে সমুদ্র মন্থনের সময় ধনত্রয়োদশী তিথিতে দুধসাগর থেকে উত্থিতা হন দেবী লক্ষ্মী। তাই এই দিনে লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করা হয়। অনেক জায়গায় আবার আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের জনক ধন্বন্তরীর পুজো করা হয় ধনতেরাসের দিন। মানবজাতির সুস্থতার কামনায় এবং নীরোগ শরীরের প্রার্থনায় ধন্বন্তরীর পূজা করা হয়। হিন্দু পুরাণে বলা হয়, সমুদ্র মন্থনের সময় এক হাতে একটি কলসের মধ্যে অমৃত নিয়ে এবং অন্য হাতে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের মূলগ্রন্থ নিয়ে সমুদ্র থেকে উঠে আসেন ধন্বন্তরী। তাঁকেই দেবতাদের মধ্যে বৈদ্য বলা হয়।
এই ধনতেরসের দিন রাত্রের প্রদীপ জ্বলে ওঠে যখন ঘরে ঘরে দেবী লক্ষ্মীর পুজো শুরু হয় গোটা দেশজুড়ে। তার সঙ্গে চলে ভজন, দেবী লক্ষ্মীকে নিয়ে নানাবিধ তি। বহু মিষ্টি নৈবেদ্য হিসেবে অর্পণ করা হয় দেবীকে। মহারাষ্ট্রে এই নৈবেদ্য হিসেবে ধনে বীজের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে অর্পণ করা হয়। দীপাবলির আগে আসে এই দিনে সকলেই নিজ নিজ ঘর পরিষ্কার করে রাখেন। বাড়ির সদর দরছো আলোকিত হয় নানা রঙের প্রদীপ, লণ্ঠন ইত্যাদি দিয়ে এবং দরজার সামনে আঁকা হয় রঙ্গোলি। সম্পদ ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীকে আবাহন জানাতে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় বিন্যাসে এই রঙ্গোলি আঁকার রীতি চলে আসছে বহুকাল ধরে।
হিন্দুরা এই দিনটিকে বিশেষভাবে কিছু কেনাকাটার জন্য শুভ সময় বলে মনে করেন। সোনা, রূপোর গয়না বা অন্য কোনো ধাতু কিনে থাকেন অনেকে। ফলে এই সময় সোনার অলঙ্কার কেনার একটা চল নামে সারা ভারত জুড়ে। মুলত অবাঙালিদের মধ্যে এই ধনতেরস পালনের রীতি থাকলেও বর্তমানে বাঙালিরাও এই ধনতেরাসকে তাদের উৎসবের তালিকায় স্থান দিয়েছে।
তস্কর
(দেবেশকান্তি চক্রবর্তীর নির্বাচিত গল্প থেকে নেওয়া)
ভীষণ ঠান্ডা। তার ওপরে ঝিরঝিরানি বৃষ্টি। এমনি রাতে পারে একটা লোক ঢুকেছে। হাতে একটা সিঁদকাঠি আর একটা বাজারের চটের থলে।গায়ে তার শুধুমাত্র জামা, প্যান্ট শীতবস্ত্র নেই। এমনি সিটির মধ্যে আবার ভয়ের শীত। শীতের সাঁড়াশি আক্রমণ লোকটি কেঁপে যাচ্ছিল সারাক্ষণ।
এই পারাটা তার চেনা। রাস্তাঘাট মুখস্ত, কাদের কুকুর বিপদজনক, কাদেরগুলি খেকুরে, কোন কুকুরফ লেজ নারে, সবকটা খবর রাখে। বাসিন্দাদের অবস্থা সমন্ধেও সে ওয়াকিবহাল। কয়েকটা বাড়ি ডাইনে -বাঁয়ে রেখে লোকটি এগিয়ে গেল এক অধ্যাপকের বাড়িতে। মনে মনে চোখ কোষে রাখলো সবার ঘরের দরজা বন্ধ হলেই রান্না ঘেটে অভিযান চালাবে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করছিল আর নিদুটি মন্ত্র জপ করছিল। ভেতরে অন্ধ্যাপক ছেলেকে অংক শেখাচ্ছেন। তাহলে কি রাট বেশি হয়নি। অধ্যাপকের স্ত্রী ঘরে এসে বললেন, – কি ভীষণ দুর্যোগের রাত। আজ বোধহয় অমাবস্যা, একেবারে চোরের রাত। ছেলে অংক ভুলে বললো, মা, আজ হয় আসবে? অধ্যাপক চিৎকার করে বললেন, ছাই আসবে, গাধা কথাকার। সব অংক ভুল করেছিস। সিঁড়ি ভাঙাটার অর্ধেক ভেঙেরেখেছিস। হাজার বার গিলিয়ে দিলেও মাথায় ঢোকে না, হতভাগা খাবি কি করে? মুটে মজুর তো হতে পারবিনা, ওই প্যাকটির মতো চেহারা। অধ্যাপকের ছেলেটি বড়োই ডেপো। বলে ফেললো, চুরি করে খাব, শুনে অগ্নিশর্মা অধ্যাপক সবেগে প্রহার শুরু করলেন। ছেলেটি দীর্ঘ সময় হা করে থেকে হঠাৎ বিকট আওয়াজ শুরু করেদিল।
লোকটি বুঝতে পারলো এখানে বিশেষ সুবিধে হবে না। আলতো পায়ে দেউড়ি থেকে নেমে, রক্ষণাত্মকভাবে, পান পুকুরের পাশ দিয়ে, ঈশান কোন বাঁশঝাড়, হিজল বোন ডাইনে রেখে কাঁপতে কাঁপতে এক কেরানির দেউড়ি পাড় হল।
এই কেরানীতি অন্য বেশিরভাগ কেরানির মতো গোবেচারা ছিল না। মাস পয়লার বেতন ভেঙে মদ খাওয়ার মতো শক্ত কলেজ ছিল। লোকে বলে কেরানির বৌটি অতিমাত্রায় উচ্চাকাঙ্খী তাই লোকটা ঘুষের জন্য ভারী জেড করে। কেউ কেউ বলে, লোকটার একটা বিবেক ছিল। সেই বিবেক হঠাৎ হঠাৎ দাঁড়িয়ে ওর পিঠে লাঠি মারে, লোকটা তখন বিবেকটাকে ডোজ দিয়ে দেয়।
চোর এসব তথ্য জানে। সে ভাবলো এর ঘরে অনেক বেহিসেবি টাকা যত্রতত্র ছড়ানো থাকতে পারে। ঘুমিয়ে পড়লেই টালি সরিয়ে ভেতরে ঢুকবে। কুম্ভ করনের দোহাই দিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
লাগ লাগ নিদুটি, নগর বেড়ে লাগ
আগম ডাকিনি মন্ত্রে নেই কুত্তা ভাগ।
ইঁদুর মাটি, নিদ্রাদেবী, সিঁদ কাঠির দোহাই,
যে যেখানে জেগে আছে, সবার উঠুক হয়- ।
কিন্তু, ঘরের ভেতরে ধুন্দুমার শুরু হয়ে গেল। যেন তার পোড়াকপালের অপেক্ষেতেই ছিল। মেয়ের পড়া শেষ হতেই মেয়ের মা জোর করে মেয়েটার সরু সাপ্রু দুপায়ে বোঝ বোঝা ঘুঙুর বেঁধে দিয়ে বললেন, – নাচ, “ধা ধিন ধিন ধা, ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন তা, ধিন ধিন ধা- …”
মেয়েটির ঘুম পাচ্ছে, কিছুতেই মায়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। মা তখন হাল ছেড়ে মেয়ের কবুতরের মতো এক রত্তি পিঠে ধুম করে একটা কীল মেরে বলে উঠলেন- পড়াশোনায় কচু, নাচে লবঘনটা, আর তোর বাপের এই হাল, নাচ-গানের মাস্টারীও যদি শিখতে না প্যারিস কি করে খাবি, বদমাশ। লোকটি দশ পা পিছিয়ে গেল। বুকে বিলক্ষণ একটা ধাক্কা লেগেছে। প্রথমবার এতটা ভাবেনি, এবার ধাক্কাটা বেশ জমে বসেছে। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল সংস্কৃত পন্ডিতের বাড়ির দিকে।
পন্ডিত পুত্র বললো, শুধু নং মানেটা বুঝলাম নম্বর। বাদবাকি ঘন্টার শব্দ?
– ওরে মুখ্যু, ওটা বীজমন্ত্র, ওটা দিয়ে জজমানকে ভয় খাওয়াতে হয় অন্ধকারে স্থানু হয়ে থাকা লোকটির কাঁপুনি বেড়ে যাচ্ছিল। সংস্কৃত প্রতিটি শব্দ মনে হচ্ছিল চোরের প্রতি অভিলসাপের মতো। সংস্কৃতের বকুনি থামলে পন্ডিত সমস্যায় পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ভালো করে যোজন জাজন শিখে নে, দিন কাল খারাপ-। কি করে খাবি? চোর এক চাষির ঘরে হানা দিল। শুনতে পেল চাষি তার ছেলেকে মুখে মুখে শিক্ষা দিচ্ছে,
ভোরেতে ধরিও হাল, দিনমনির আগে
উঠিয়া প্রণাম দিও তার রক্তরাগে।
চাষি তার পর মরণ কালে ধরাশয়ী রাবনের বিখ্যাত উক্তিটা আউড়ে দিল,
ভাল, করিতে উত্তম কার্য বাঁচা যবে হবে,
আলস্য ত্যজিয়া কার্য তখনই করিবে।
এরপর হোঁচট খেতে খেতে শ্মশানের কাছে এসে চোর এই সভ্য সমাজকে অকথ্য কুকথ্য ভাষায় গল্ মন্দ করল। সে ভেবে পায়না, এত কষ্ট তবু সবাই কেন উত্তরাধিকারীদের সততার পাঠ দেয়, লড়াই করে। মানুষের মতো বাঁচার শিক্ষা দেয়। সেই বাঁচাটার কেমন স্বাদ সেট জানেনা। তাহলে কি সে এই মাটি মায়ের না? ইনিয়ে বিণিয়ে বুক ঠেলে অভিযোগের পর অভিযোগ। এই প্রথম সে খালি হাতে ঘরে ফিরলো।
ভীষণ ব্যগ্রতায় তার ঘুমন্ত ছেলেকে টেনে তুললো ঘুম থেকে। চোরের বৌ বুঝতে পারলো আজ কোন আমদানি হয়নি, ঘরের লোকটা তারা খেয়েছে, সে পাশ ফিরল।
-এই বাপ শোন, মানুষ বড় পাষান। ভীষণ মারে। মেরে ফেলতে চায়। সব সয়ে নিবি আর………? লোকটি কথা হাতড়ে। বুকের স্ফুরিত অভিমান তীব্রতর করে। – আর, বৃষ্টির মতো অবিরাম মারের সময় ভগবানকে ডাকবি। মানুষ কেন মারে? কেন, এক পেট ভাতের আশায় চুরি করে। মামলায় ভগবানকে সাক্ষী রাখবি।
চোর অঝোরে কাঁদে। মুখটা একেবারে ভিজে যায়। ছেলেটা ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
আপনিও হয়ে উঠতে পারেন নামী লেখক। ছোট গল্প, কবিতা, শিক্ষামূলক লেখা পাঠান আমাদের ই-পোর্টালের মেইল আইডিতে। বিভাগীয় সম্পাদক , ’শনিবারের বিকেল’ times.14.2020@gmail.com