শনিবারের বিকেল : 25 June, 2022

আরও পড়ুন

সমাজসংস্কারকের মূর্ত প্রতীক রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ত্ব

রাজা রামমোহন রায়

ঊনবিংশ – শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ফলে যে-সব মনীষী আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও কর্মে সামাজিক কুসংস্কার ও কূপমণ্ডূকতার অবসান ঘটাতে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় হলেন অগ্রগণ্য। ফারসি আরবি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত রামমোহন ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষিতদের মধ্যে অগ্রণী ছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চত্যে শিক্ষাচিন্তায় তার বিহার ছিল অনায়াস, স্বচ্ছন্দ। এই মহান মনীষী সম্পর্কে শ্রীমতী কোলেটের মন্তব্য অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়- “Rammohan stand in History as the úniving bridge, over which India marches from her unmeasured past to her incaúcuúabúe frture”. (S. D. Couuet: Life and Letter of Raja Rammohan’,

রামমোহন রায়, যিনি সচরাচর রাজা রামমোহন রায় বলে অভিহিত, (২২ মে, ১৭৭২ – সেপ্টেম্বর ২৭, ১৮৩৩) বাংলার নবজাগরণের আদি পুরুষ। তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি ধর্মীয়-সামাজিক পুনর্গঠন আন্দোলন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি একজন বাঙালি দার্শনিক। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্ম এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পেরেছিলেন। তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়েছেন সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টার জন্য। ভারতে দীর্ঘ কাল যাবৎ বৈষ্ণব বিধবা নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণ যেতে বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করা হত।

রামমোহন রায় কলকাতায় ২০ আগস্ট, ১৮২৮ সালে ইংল্যান্ড যাত্রার আগে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এই ব্রাহ্মসমাজ এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন এবং বাংলার পুনর্জাগরণের পুরোধা হিসাবে কাজ করে।১৭৭২ সালের ২২শে মে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ও ব্রাহ্মণ পরিবারে রামমোহন রায়ের জন্ম হয়েছিল। তার প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কার্য করতেন। সেই সূত্রেই ‘রায়’ পদবীর ব্যবহার বলে অনুমান করা হয়। কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র ব্রজবিনোদ রামমোহনের পিতামহ। তার পিতার নাম রামকান্ত। রামকান্তের তিন বিবাহ। মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা ও দুই পুত্র: জগমোহন ও রামমোহন। এঁদের বংশ ছিল বৈষ্ণব, কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা। রামকান্ত পৈতৃক এজমালি ভদ্রাসন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে স্ব-পরিবারে উঠে যান। তার পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণব এবং মাতা তারিণী দেবী ছিলেন শাক্ত। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানা স্থান ভ্রমণ করেন। কাশীতে ও পাটনায় কিছুকাল অবস্থান করেন। এছাড়া তিনি নেপালে গিয়েছিলেন। এর আগে তার সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের (পরে হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধূত নামে পরিচিত) যোগাযোগ হয়। নন্দকুমারের সহযোগিতায় রামমোহনের সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য হয়, তার বেদান্তে অনুরাগ জন্মে। ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় হরিহরানন্দই তার দক্ষিণ-হস্ত ছিলেন। বারাণসী থেকে প্রথাগত সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার পর তিনি পাটনা থেকে আরবি ও ফারসি ভাষা ভাষা শেখেন। পরে তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও শেখেন।

তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবিতে) তুহফাতুল মুহাহহিদিন। বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রাহ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয় বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। রক্ষণশীল ব্যক্তিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তার লেখার প্রতিবাদ দেখাতে লাগলেন। এই সব প্রতিবাদ কটূক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। রামমোহনও প্রতিবাদের প্রতিবাদ করলেন যুক্তি দিয়ে ও ভদ্রভাষায়। প্রতিবাদ-কর্তারা অবিলম্বে থেমে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদ-কর্তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এঁর গ্রন্থের নাম ‘বেদান্তচন্দ্রিকা’। বেদান্তচন্দ্রিকা’র প্রতিবাদে রামমোহন ভট্টাচার্যের সহিত বিচার লিখে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখালেন আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নাম ও রূপ দেন। সাহেবদের বাংলা শেখানোর জন্য তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে ব্যাকরণ রচনা করেন।

বেদান্ত-উপনিষদগুলি বের করবার সময়ই তিনি সতীদাহ অশাস্ত্রীয় এবং নীতিবিগর্হিত প্রমাণ করে পুস্তিকা লিখলেন ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’। প্রতিবাদে পুস্তিকা বের হল ‘বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ’। তার প্রতিবাদে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুস্তিকা বের হয়। এই বছরেই ডিসেম্বর মাসে আইন করে সহমরণ-রীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তবুও গোঁড়ারা চেষ্টা করতে লাগল যাতে পার্লামেন্টে বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হয়। এই চেষ্টায় বাধা দেওয়ার জন্য রামমোহন বিলেত যেতে প্রস্তুত হলেন। এব্যাপারে তাকে আর্থিক সহায়তা দান করেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। মোঘল সম্রাট ২য় আকবর তার দাবি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করার জন্য ১৮৩০ সালে রামমোহনকে বিলেত পাঠান, তিনি রামমোহনকে রাজা উপাধি দেন।

পাশ্চাত্য চিন্তায় প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব রাজা রামমোহন রায়ই আধুনিক ভারতের প্রথম পথিকৃৎ। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বরেণ্য পূজারি হিসেবে তিনিই ‘ভারতের আধুনিক মানুষ’ তথা নবযুগের প্রবর্তক। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ সেপ্টেম্বর সুদূর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে তাঁর জীবনবাতি নির্বাপিত হয়। উনিশ শতকের নবজাগরণের মূর্ত প্রতীক হিসেবে, পুরুষাকারের জীবন্ত প্রতীক হিসেবে, সমাজসংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায় আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন।

অণুগল্প

গল্পের নামঃ পিঠেপুলি 

প্রেরকঃ সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায়
পাটিসাপটা কেমন হয়েছে?তোমার প্রিয়।বললেন মৈত্রেয়ী।
দুধপুলি রাখলেন বাটিতে।
 দুধটা ঘন কম হলো।দ্যাখো তোমার পছন্দ হয় নাকি।
 আস্কে পিঠে একটাই দিলাম।তোমার অম্বল হয়।
গুড়মাখা একটা আস্কেপিঠে দিলেন থালায়।
দেবপ্রিয়র ছবিতে গোড়ে মালা।জ্বলছে ধূপ।গতবছর পৌষসংক্রান্তির দিন চলে গিয়েছেন পিঠেপ্রেমিক মানুষটি।স্বামীর মৃত্যুদিনে নানারকম পিঠে তৈরি করে ছবির সামনে রাখলেন মৈত্রেয়ী।
শব্দসংখ্যা-৫৩
সব্যসাচী বন্দ্যোপাধ্যায়

                                                            ছোটগল্প

                                                          চলে যেতেই হবে!

                                                           –রবি মল্লিক

পূব আকাশে সূর্য্যের উপস্থিতি লক্ষ্য করে পাখিরা কিচির মিচির স্বরে বাসা থেকে রওনা দেয় এক অনিশ্চিয়তার জগতে খাদ্য লাভের উদ্দেশ্যে ৷ পাওয়া না পাওয়া সবটাই ভাগ্য তথা সংযোগের উপর নির্ভরশীল ৷ বাসায় উপস্থিত সদ্যোজাত শিশু তথা সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য ছুটতে হয় তাদের ৷ পরিবারের সবচেয়ে  শক্তিশালী এবং যোগ্য সদস্যদের উপর এই কর্তব্য বর্তায়৷ এটি সংসারেরই এক অলিখিত নিয়ম৷

                 সকাল পাঁচটায় ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজতেই বিদ্যুত বিছানা ছেড়ে উঠে গেল৷ ছটা থেকে তাকে প্রাইভেট টিউশনি ক্লাসে যেতে হয় ৷ প্রতিদিন সকালের শুরুটা বিদ্যুতের এমনি করেই হয়৷ পরপর দুটি ব্যাচ পড়িয়ে বিদ্যুত বাড়ি ফেরে ন’টায় আবার কোন-কোন দিন সাড়ে ন’টাও বেজে যায়৷ যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির মতো স্নান খাওয়া সেরে রওনা হয় স্কুলের দিকে৷ গতবছরই বিদ্যুত শহরের একটি বেসরকারী বিদ্যালয়ে সহশিক্ষক পদে যোগদান করে৷ মাসমাইনে সাত হাজার টাকা৷ আর সাথে টিউশনি করে আরও হাজার ছয়েক গুছিয়ে নিয়ে সংসারের জন্য ব্যয় করে৷ বিদ্যুত সহ পরিবারের জনসংখ্যা পাঁচ – মা, বাবা , বোন আর দিদা৷ বোন কলেজে ভর্তি হয়েছে এই বছর৷ মা গরমমসলার প্যাকেট তৈরী করেন, প্রতি হাজার প্যাকেট তৈরী করলে পনেরো টাকা পাওয়া যায়৷ বাবা অসুস্থ ; নিয়মিত ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়৷ আর দিদার বয়স আশি অতিক্রান্ত হয়েছে ৷

বিদ্যুত ছোটবেলা থেকেই ইতিহাস পড়তে খুব ভালোবাসত৷ স্কুলের লাইব্রেরী থেকে পুরোনো পুরোনো বিভিন্ন ইতিহাসের বই এনে রাতে ডিমলাইটের আলোয় পড়তো৷ পড়তে পড়তে প্রায় দিনই ডিমলাইটের তেল ফুরিয়ে যেতো৷ যার জন্য মায়ের কাছে বকাঝকাও খেয়েছে প্রচুর ৷ কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিদ্যুত ইতিহাসে একশোয় পুরো একশো পেয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো ৷ মায়ের মুখে সেদিন বকুনি ছিলো না,  শুধুই স্নেহের জল গড়িয়ে এসেছিল চোখে৷ বিদ্যুত আজ ইতিহাসে এম.এ এবং বি.এড ডিগ্রীধারী ৷ স্বপ্ন ছিলো শিক্ষকতা করবে ৷ কিন্তু রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগের করুণ দশা আর অসাধুতার জন্য পরীক্ষায় বসারই সুযোগ হয়নি ৷ তাই সে  বেসরকারী বিদ্যালয়  থেকেই কর্মজীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ মাসিক বেতনের পরিমাণ কম হওয়া সত্বেও……৷ প্রতিদিন তাকে সকাল দশটা চল্লিশের মধ্যেই বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয়; তা না হলে চাকরি চলে যেতে পারে ৷ সপ্তাহে তিনদিন নিয়ম করে স্কুল ছুটির পর শিক্ষকদের একটি সার্বজনীনন মিটিং হয় , বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ৷ যেদিন মিটিং হয় সেদিন সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায় বিদ্যুতের বাড়ি ফিরতে৷ এইভাবে কয়েকটা টিউশনি ছুটে গেছে৷ তাই সাতসকালেই শুরু হয় ওর জীবিকা নির্বাহের অক্লান্ত দৌড়৷ আয়ের পথ একটিমাত্র হলেও খরচের দ্বার অনেক! বিদ্যুত থামতে চায়না৷

বিদ্যুত এখন পরিবারের শক্তি ৷ সংসারের সিংহভাগ খরচই সে চালায় ৷ বোন সর্বাণী খুব বুদ্ধিমতী এবং লক্ষ্মীমন্ত একজন মেয়ে ৷ সেও টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে নেয়৷ সে বোঝে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে কিভাবে সব দিক সামাল দিয়ে চলতে হয়৷

‘কিরে খোকা ওঠ্, স্কুলে যাবি তো৷ সাড়ে ন’টা বেজে গেছে’- মা ডাকে বিনয়কে৷ ‘ধুর! উঠছি খানিকক্ষণ পরে৷’- বিরক্তি ভরা স্বরে উত্তর দেয় বিনয়৷
-” রাতভর মোবাইল টিপবি, আর বেলা দশটা অব্ধি ঘুমাবি৷ তোকে নিয়ে আর পারিনা বাপু৷”
-” যাও তো এখান থেকে , মা৷” মা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়৷

বিনয় বছর ছাব্বিশের এক যুবক৷ দুবছর আগেই সরকারি প্রাইমারী স্কুলে চাকরি পাকা হয়েছে ৷ বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে পনেরো মিনিটের পথ সেই স্কুল ৷ তবুও সে আড়াই লক্ষ টাকার একটি চোখ ধাঁধান বাইকে চেপেই যাতায়াত করে৷ বিনয়ের বাবা অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার এখন এস.আই অফিসে কর্মরত৷   মা গৃহবধূ৷ বিনয়ের একজন দিদি আছে ; সে বিবাহিত; স্বামী আয়কর দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মী৷

বিনয় প্রতিদিন সকাল দশটার কাছাকাছি সময়ে বিছানা ত্যাগ করে স্নান খাওয়া সেরে স্কুলে যায়৷ এগারোটা নাগাদ ক্লাস শুরু হয়৷ দু ঘন্টা পর থেকেই বাচ্চারা খেলতে শুরু করে আর বিনয় তার সহকর্মী ও সহকর্মিণীদের সাথে মিড.ডে.মিল তৈরীতে জুটে যায়৷ এরপর আবার ছবি তুলে উচ্চ দপ্তরে পাঠাতেও হয়৷ মেলা কাজ! দিনে দুঘণ্টার বেশি লেখাপড়া হয়না স্কুলে ৷ বিনয়ের স্কুলে নথিভুক্ত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দুশো বাহান্ন কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, প্রতিদিন বাইশ-পঁচিশ জনের বেশি আসে না৷ যারা আসে তাঁরা প্রায় সবই শিজগ্রাম আর কাঁচিমুহার বাসিন্দা ৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি হয়তো এইসকল দরিদ্র বাচ্চাগুলোর জন্যই খোলা রয়েছে ৷ একবেলার খাওয়ার পাশাপাশি নূন্যতম শিক্ষালাভ টুকুও হয়ে যায়৷ বিনয়ের এক সিনিয়র সহকর্মীর ছেলে বিদ্যুতের স্কুলে লেখাপড়া করে৷ তার কারণ, ছেলের যথাযত শিক্ষাগ্রহণ প্রয়োজন , মিড.ডে.মিল -এর প্রয়োজন নেই৷

“দেখো বিনয়, আজকের কাগজের সম্পাদকীয় কলামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পর্কে কী বেড়িয়েছে? রাজ্যের প্রায় দুশো প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীর অভাবে ধুঁকছে !”- ইকবাল খবরের কাগজটি দেখিয়ে বললো ৷
” তা তো হবেই দাদা! সরকারি স্কুলের চেয়ে বেসরকারি স্কুলগুলির লেখাপড়ার পরিকাঠামো অনেক উন্নত হচ্ছে দিনদিন ৷ আর লটারি  প্রথা যদি কোনোদিন উঠে যায় তবে আমাদের স্কুলগুলি হয়তো বাতিলের খাতায় চলে যাবে৷”- বিনয় বললো ৷
-“কথাটি নেহাতই ফেলে দেওয়ার মতো নয়৷”
-“হুম্”৷
স্কুল শেষে বিনয় বাড়ি ফেরে ; খাওয়া দাওয়া করে বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পরে৷ ফেরে রাত বারোটার পর৷ বিনয়ের মা বলে মাসের দশ তারিখের মধ্যেই নাকি বিনয়ের বেতন ফুরিয়ে যায় ৷ তারপর রোজ টাকার জন্য ঘ্যানঘ্যান করতে থাকে৷

***

শরতের বিকেল ৷ পশ্চিম আকাশের দিগন্তে তখনও সূর্য্যের পুরোপুরি বিসর্জন হয়ে যায়নি ৷ আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘেরা নিয়মকানুন ভেঙে গাভীর মতো চড়ে বেড়াচ্ছে ৷ কেউ বা কারা যেন  রঙিন আবীরে রাঙ্গা করে দিয়েছে তাদের৷ প্রত্যেকেই যেন সোল্লাসে ছুঁয়াছুঁয়ি খেলছে ৷ চড়ুই পাখির দল তখন এই মুল্লুক থেকে ওই মুল্লুকে নগরকীর্তনে মত্ত আর বলাকা সারি নিয়ম মেনে নদীখাত ধরে প্যারেড করতে ব্যস্ত ৷ প্রকৃতির সকলে মিলে যেন এক অনাবিল মুহূর্ত সৃষ্টি করেছে ৷ নদীর ধারে অবস্থিত পার্কের বেঞ্চিতে বিদ্যুত বসে রয়েছে ; পাশে তার প্রেমিকা রূপশা ৷ রূপশা রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ৷ দুবছর আগে  ওদের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল ৷ রূপশা বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে ; বাবা কলেজের অধ্যাপক৷
” বাবা বলেছে বি.এ শেষ করলেই বিয়ে দিয়ে দেবে৷”- রূপশা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানায় বিদ্যুতকে৷
“তাতে ভয় কী? আমি তো এখন একটি স্কুলে পড়াচ্ছি৷ “- বলে বিদ্যুত ৷
-“কিন্তু বাবা সরকারি চাকুরিজীবী ছাড়া আমার বিয়ে দেবেন না৷”
-” কেন? আমি কি এতোটাই অযোগ্য !”
-” না তা নয়! বাবা যা বলেছেন আমি সেটাই বললাম৷”
-” আমি তোমার দায়িত্ব নিতে পারবো রূপশা৷ প্রয়োজনে আরও বেশি বেশি টিউশনি পড়াবো৷ তোমার ছোটবড়ো সব বিষয়ের যত্ন নেব আমি৷”
-” আচ্ছা বাবা আচ্ছা! বাদ দাও সেসব কথা৷”
এই বলে রূপশা দাঁড়িয়ে পরে এবং হাত বাড়িয়ে বিদ্যুতের হাত টেনে নেয়৷ দুজনেই নদীর পার ধরে হাঁটতে থাকে৷ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে ৷ বিদ্যুতের চোখেমুখে সেই সন্ধ্যার ছাপ ফুটে ওঠে পরিষ্কার ৷

***

আজ স্কুল ছুটি ৷ হরতাল ৷ গয়ালাল মাঠে একটি নক্ আউট ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছে ৷ মোট ষোলটি দলের খেলা৷ প্রতি খেলা হবে পনেরো মিনিটের ৷ কাজের চাপ না থাকায় বিদ্যুত তার চিরসঙ্গী সাইকেল নিয়েই উপস্থিত হয়েছে মাঠে খেলা দেখবে বলে ৷ হঠাৎই বিনয়ের সাথে তার দেখা৷ বিনয় আর বিদ্যুত একই পাড়ায়  থাকলেও খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয়না৷
-” কিরে বন্ধু বিদ্যুত, কেমন আছিস?”- বিনয় জিজ্ঞাসা করে৷
-” এই তো একই রকম চলে যাচ্ছে রে বন্ধু ৷”- বিদ্যুত দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায়৷
-” তারপর, তোর স্কুল কেমন চলছে ?”
-” খুব চাপ রে ভাই৷ প্রতিদিন লেসন্ প্ল্যান তৈরী করে যেতে হয় ক্লাসে ৷”
-” কী বলিস! প্রতিদিন৷”
-” হ্যাঁ রে৷ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান যে; পরিশ্রম ওরা করিয়েই নেয়৷”
-” আচ্ছা আচ্ছা৷ বেতন কতো দিচ্ছে এখন৷”
-” আ…. এখন ওই দশ হাজার দেয়৷”- ইতস্তত হয়ে বিদ্যুত জানায়; সাত হাজারের কথাটা বলতে পারেনা সে!
-” ও.. আচ্ছা ৷ আর এদিকে দেখ্ আমাদের রাজ্য সরকার আমাদের ডি.এ বাবদ কতগুলি টাকা আটকে রেখেছে৷ মাত্র কুড়ি হাজার বেতনে কি আর চলে বল্ আজকের বাজারে ৷”- বিনয় বলে ৷ বিনয়ের মুখের কথাগুলি বিদ্যুতের প্রহসন মনে হয়৷ যে ছেলে উচ্চমাধ্যমিক দুইবার ফেল মেরে উতরেছে; কলেজের গন্ডি আজও টপকাতে পারেনি; সে কুড়ি হাজারের সরকারি চাকরি করছে , এ’ই তো ঢের ৷ আবার কিনা ডি.এ ৷ মনে মনে ভাবতে থাকে বিদ্যুত ৷
বিনয়ের চাকরির খবর যখন পাড়ার  জানাজানি হয়েছিলো, তখন সবাই আশ্চর্য্য হয়ে গিয়েছিলো ৷ কেউই কোনদিন ভাবেনি যে বিনয়ও সরকারি শিক্ষক হবে ৷ যদিও আজ সমাজে বিনয় প্রতিষ্ঠিত ৷ বেকার নয় ৷ একজন ছেলের জীবনের সমস্ত কালিমা, দোষ সব ধুয়ে মুছে ঝকঝকা করে দিতে পারে একটি সরকারি চাকরি৷ চাকরি পাওয়ার পর সে পরামর্শদাতা হয়ে ওঠে! আর ‘ডিগ্রীধারী শিক্ষিত বেকার’ বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড়ো গালি৷ একজন শিক্ষিত বেকারকে সবাই বুদ্ধি দিতে পারে , চায়ের দোকানের সবজান্তা কাকাবাবু থেকে শুরু করে বাজারের সব্জিওয়ালা ৷ বেকার মানেই সমাজের এক অভিন্ন পরিত্যক্ত প্রাণী৷  এমনই সময় বিনয় তার সুন্দরী প্রেমিকাকে নিয়ে রওনা দেয় কোনো বিশেষ স্থানের দিকে৷ বিদ্যুতও বাড়ি ফেরে৷ ফেরার পথে বিদ্যুতের মনে আসে প্রায় বছর খানেক আগের কথা৷ বিনয়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত ছিলো সে৷ বিনয়ের মা বলেছিলো,” বাবা বিদ্যুত , চাকরির জন্য বসে না থেকে কোনো কাজকর্ম কর্ ; দোকান খোল্ বা কিছু ফেরি কর্ ; তাতে পয়সা আছে কিন্তু ৷ সবার ভাগ্যে তো আর সবকিছু থাকেনা৷” বিদ্যুতের বুকে বজ্রপাত হয়েছিল সেই রাতে, বৃষ্টি নেমেছিলো চোখের আঙ্গিনায় ! সে

বুঝেছিল , ছাত্র হিসাবে সে যতো ভালোই থাকুক না কেন; চাকরি না পেলে তার কোনো মূল্য নেই৷

**

গত সপ্তাহে রূপশার ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট দিয়েছে ৷ সেইদিন থেকেই তার ফোনটা বন্ধ আসছে  ৷ বিদ্যুত বুঝে উঠতে পারেনা সে কী করবে৷ দীর্ঘ চেষ্টার পর তার রূপশার সাথে দেখা করা সম্ভব হয়৷ তারা নদীতীরে সেই পার্কে গিয়েই বসে ৷ রূপশা বাড়ি ফেরার তাড়া দিতে থাকে৷ আসন্ন বিপদের কথা আশঙ্কা করে বিদ্যুতের হৃদগতি বেড়ে যায়৷ সে জিজ্ঞাসা করে,” কী হয়েছে রূপশা ? তুমি এমন করছো কেন?”
-” দ্যাখো বিদ্যুত , আমার মনে হয় আমাদের আজই সমস্ত বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন ৷”- জানায় রূপশা,
-” কী বিষয়?”
-” আমাদের এই সম্পর্কে বিষয়ে৷ বাবা আমার বিয়ে অন্যত্র ঠিক করেছে৷ আমার আর কিছু করার নেই৷”
-” কী বলছো তুমি ! তোমার কিছু করার নেই!”
-” না! আমি বাবাকে না করতে পারিনি৷”
-” কিন্তু আমার কথাটি একবারও তুমি ভাবলে না! রূপশা৷”
-” ভেবেছি; অনেক ভেবেছি৷ ভেবে-চিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ কী আছে তোমার ? কী দিতে পারবে তুমি আমায় বিয়ের পর৷ একটা তো সরকারি চাকরিও জোটাতে পারোনি৷ ওই টিউশনি আর সাত হাজারি চাকরি দিয়ে আর যাই হোক সংসার চলবে না৷” অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিদ্যুত ৷ অতি পরিচিত মানুষকে অচেনা লাগে ৷ রূপশা আবার বলে ,” তোমার না আছে কোনো ফ্যামিলি বিজনেস  আর না আছে ঠিকঠাক গোছের একটা বাড়ি৷ নিজের চেহারাটা একবার আয়নায় দেখেছো, আমাদের একসাথে কোনোদিনও মানাবে না৷ আমি জীবন নিয়ে খুব সচেতন আর তাই এই বিয়েতে রাজি হয়েছি৷”
-” ছেলে কিসের চাকরি কর?”
-” প্রাইমারী টিচার ৷” এই বলে রূপশা উঠে পরে ৷ অন্যান্য দিনের মতো হাত এগিয়ে দেয়না বিদ্যুতের দিকে ৷ রূপশা বাড়ির দিকে ফেরে৷ বিদ্যুত নদীর জলেই তাকিয়ে থাকে৷ সরকারি চাকরির কাছে ওর নিখাদ ভালোবাসা পরাজিত হয়৷  পকেট থেকে একজোড়া রূপোর পায়ের তোরা বের করে বিদ্যুত ৷ চোখের জলে সিক্ত সেই পায়েল নদীর জলে বিসর্জন দেয় ৷ কর্তব্যের পিছুটানে বাবার ঔষধ নিয়ে ঘরে ফেরে৷ নতুন সকাল , নতুন সময়ে বিদ্যুত তার পুরোনো নিয়ম মেনেই কাজ করতে থাকে৷ তবে কিছু কাজ কিছু অভ্যাস চিরতরে বদলে যায়৷

**

মাস তিনেক পর বিদ্যুতের বাড়িতে বিয়ের কার্ড আসে৷ মা জানায় বিনয়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ এসেছে ৷ বউভাতের অনুষ্ঠানে যেতে হবে সপরিবারে ৷ উপস্থিত হয় সেই লগ্ন ৷ রাত দশটায় বিদ্যুত তার বোনকে নিয়ে হাজির হয় নেমন্তন্ন রক্ষা করতে বিনয়দের বাসায়৷ নতুন বউয়ের হাতে উপহার তুলে দিতেই তার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে৷ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেনা সে রূপশাকে নববধূর সাজে দেখে৷ বোনকে পাশের বাড়ির কাকিমাদের সাথে রেখে বিদ্যুত নেমে আসে ছাদ থেকে ৷ রওনা দেয় ৷ নিজের স্বপ্নগুলোকে অন্যের ঘরে দেখে প্রবল ঝড় বইতে থাকে তার বুকে৷ গলা ফাটিয়ে উন্মাদের মতো চিৎকার করতে চায় কিন্তু পারেনা৷ নদীর ধারে খেজুর তলায় বসে কাঁদতে থাকে৷ খুব বেশি দুর্বল , অপদার্থ তথা অযোগ্য মনে হতে থাকে তার নিজেকে ৷ সে দেখে খেজুরের পাতার ফাঁক দিয়ে পূর্ণ চাঁদের জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়ে পরেছে দিক থেকে দিগন্তে ৷ জ্যোতিষ্কমণ্ডলী যেন টিমটিম করছে জ্বলছে আর সোল্লাসে মেতে উঠছে৷ খণ্ড খণ্ড কালো মেঘ ভেসে চলেছে নিজের গন্তব্যে কোনো এক পর্বতচূড়ার উদ্দেশ্যে ৷ নদীর জল যেন চাঁদের বিচ্ছুরিত রুপোলি আভা পান করছে৷ আজ যেন প্রকৃতি এক নববধূর সাজে নিজেকে সাজিয়েছে ঠিক রূপশার মতো৷ যে রূপ দেখার জন্য বিদ্যুত এতকাল অপেক্ষা করেছে আজ  সেই রূপই……৷ বিদ্যুত বুঝতে পারে তার দুঃখে কারোর কিছু এসে যায়না ৷ কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে যাদের অনেক কিছু এসে যেতে পারে তাদের জন্যই তো বিদ্যুতকে লড়ে যেতে হবে শেষ অব্ধি ৷ চোখ মুছে ঘরের দিকে হাঁটা দেয় বিদ্যুত ৷

আপনিও হয়ে উঠতে পারেন নামী লেখক। ছোট গল্প , কবিতা , শিক্ষামূলক লেখা পাঠান আমাদের ই-পোর্টালের মেইল আইডিতে। বিভাগীয় সম্পাদক ,’ শনিবারের বিকেল’ times.14.2020@gmail.com

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close