অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২০ সালের ৩ জুন অর্থাৎ আজকের দিনে চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁয় জন্মালেও, ৫ বছর বয়স থেকে তাঁর বাস হাওড়ায়৷ ছোটবেলা থেকেই তুখোড় ছিলেন লেখাপড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর প্রথম স্থানটি বাঁধা ছিল। যেমনি মেধা, তেমনি ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি এবং গবেষণার নিরলস খিদে। জীবনের একেবারে শেষ লগ্ন পর্যন্ত এই দুটোই ছিল তাঁর মূল স্তম্ভ। ছাত্রাবস্থায় আইএ পরীক্ষায় কেবল বাংলাতেই নয়, আসামের পরীক্ষার্থীদের মধ্যেও প্রথম হন তিনি। সাধারণত আমরা মনে করি, এই ধরনের তুখোড় ছাত্র বা ছাত্রীরা বেশ গম্ভীর, সিরিয়াস, রাশভারী ধরনের হন। কিন্তু, অসিত বাবু মোটেই এই পথের পথিক ছিলেন না।
বাস্তব জীবনে তিনি ভীষণ রকমের ছাত্রদরদী ছিলেন। আরেকদিকে ছিলেন তেমনি রসিক। বাংলা সাহিত্যে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা এলেই যে বইটির নাম মাথায় আসবে, তা হল ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত‘। নয়টি খণ্ডে প্রকাশিত এই বিশাল কাজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। গবেষণার কাজে একফোঁটাও ফাঁক রাখেননি তিনি। একদিকে অধ্যাপনা করেছেন, অন্যদিকে কাজ সেরেই ছুটেছেন লাইব্রেরিতে। আজও বাংলা সাহিত্যের যে কোনও পড়ুয়া এবং গবেষকদের কাছে তাঁর লেখা বইগুলি অমূল্য সম্পদ।
অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয় বনগাঁয় তাঁর মামাবাড়িতে। তাঁর পিতা অক্ষয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা চারুবালা দেবী। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা বনগাঁ ছেড়ে চলে আসেন হাওড়াতে। ১৯৩৮ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে বাংলায় ৭৭ শতাংশ নম্বর পেয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম হন। এরপর আইএ পাশ করেন রিপন কলেজ থেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে বিএ এবং এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। কলেজে পড়াকালীনই ১৯৪১-৪২ সাল নাগাদ নেতাজি সুভাষচন্দ্রের বক্তৃতাগুলির বঙ্গানুবাদ করে ফরোয়ার্ড পত্রিকায় ছাপতে শুরু করেন তিনি।
ছাত্রাবস্থায় থাকাকালীনই তাঁর লেখা গল্প ‘দেশ‘ পত্রিকা এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি এমএ পাশ করেন ১৯৪৫ সালে, এবং সেই বছরেই নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে তিনি অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরে রিপন কলেজে ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ১৯৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
উল্লেখ্য, ২০০২ সালে মৃত্যু হয় অন্নদাশঙ্কর রায়ের। তাঁর মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমির সভাপতি পদে আসীন হন এবং আমৃত্যু সেই পদেই বহাল থাকেন। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থগুলি বাংলার নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে রচিত। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ এবং বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, সাহিত্য জিজ্ঞাসায় রবীন্দ্রনাথ, হাওড়া শহরের ইতিহাস প্রমুখ।
অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনার কাজও করেছেন। সেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ গল্প শ্রেষ্ঠ লেখক, জীবনের গল্প গল্পের জীবন, সত্যেন্দ্র রচনাবলী, বিদ্যাসাগর রচনাবলী, সঞ্জীব রচনাবলী বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘স্মৃতি বিস্মৃতির দর্পণে’ নামে তাঁর একটি আত্মকথাও রয়েছে। এছাড়াও ভারতীয় পণ্ডিত বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় রচিত কল্কি অবতার এবং মহম্মদ সাহেব বইটি গবেষণা পূর্বক হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ এবং পুরাণে মহম্মদ নামে অনুবাদ এবং সম্প্রসারণের কাজ করেন তিনি। ২০০৩ সালের ২১ মার্চ এই মহান জীবনের প্রয়াণ ঘটে।
নয় খণ্ডের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’-এর মতো এইরকম মহা পরিকল্পনা নিয়ে একক প্রয়াসে এত বড় মাপের গবেষণা এর আগে বাংলা সাহিত্যে হয়নি। প্রসঙ্গত, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত-এর দশম খণ্ডটি লিখতে শুরু করে অসিত বাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এর কিছুদিন বাদেই তাঁর জীবনাবসান হয়। এই খণ্ডে কেবল রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের আলোচনাটুকুই পাওয়া যাবে।