রাধানাথ শিকদার ছিলেন একজন বিখ্যাত বাঙালি গণিতবিদ। এছাড়াও তিনি প্রথম বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ অর্থাৎ হিমালয় পর্বতমালার ১৫ নম্বর শৃঙ্গের উচ্চতা নিরূপণ করেন। জানা যায়, এই পর্বত শৃঙ্গটিই পরে মাউন্ট এভারেস্ট নাম খ্যাত হয়। এভারেস্ট – এর উচ্চতা হল ২৯০০২ ফুট অর্থাৎ প্রায় সাত মাইলের মতো — এ তথ্য কোনাে বিদেশীর নয়। এই তথ্য রাধানাথ শিকদারের আবিষ্কার। আমরা তাঁর জন্যে গর্ববােধ করি।
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে কলকাতার জোড়াসাঁকো অঞ্চলের শিকদার পাড়ায় জন্ম হয় এই বিখ্যাত গণিতবিদের। তাঁর পিতা তিতুরাম শিকদার ছিলেন সেই সময়ের উচ্চশিক্ষিত এবং সৎগুণ সম্পন্ন একজন ব্যক্তি। অন্যদিকে, তাঁর পিতার মতোই মাতাও ছিলেন জ্ঞানে গুণে সম্পন্ন। মাতা-পিতা, এক ভ্রাতা ও তিন ভগিনীকে নিয়ে তাঁর পরিবার।
বাড়িতেই পণ্ডিতের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে রাধানাথ ভর্তি হন চিৎপুরের ফিরিঙ্গি কমল বসুর বিদ্যালয়ে। পরে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হন হিন্দু কলেজে। হিন্দু কলেজে অধ্যয়নের সময় তিনি বিখ্যাত শিক্ষক ডিরোজিওর ভাবধারার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কলেজে গণিতের অধ্যাপক ড.টাইটলারের প্রিয় ছাত্ররূপে তিনি উচ্চগণিতে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে কলেজের শেষ পরীক্ষায় সুষ্ঠভাবে উত্তীর্ণ হন তিনি।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ১ম ভাগে জরিপ কাজে ব্যবহৃত গণিত বিষয়ে চর্চা প্রয়োগ উদ্ভাবনে তিনি স্বকীয়তার সাক্ষ্য রেখেছেন। এইজন্য তিনি প্রতিবারই প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে রাধানাথ শিকদার জার্মানির সুবিখ্যাত ফিলজফিক্যাল সোসাইটির ব্যাভেরিয়ান শাখার সম্মানীয় সদস্যপদ লাভ করেন। গণিতে অসাধারণ পারদর্শিতার জন্য তার এই সম্মান প্রাপ্তি।
রাধানাথ শিকদার ভারতে সেই সময় ব্রিটিশ প্রশাসনের জরিপ বিভাগ সার্ভেয়র জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার দফতরে কাজ করতেন। তিনি ১৮৪০ সালের মহা ত্রিকোণমিতিক জরিপ কাজে অংশ নেন। ১৮৫১ সালে ‘ম্যানুয়াল অফ সারভেইং(Manual of Surveying)’ নামক সমীক্ষণ পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। সেই পুস্তিকার, বৈজ্ঞানিক অংশ রাধানাথ শিকদারের রচিত। ব্যারোমিটারে সংযুক্ত ধাতব স্কেলের তাপজনিত প্রসারণ এবং পারদের নিজের প্রসারণ জনিত, পরিমাপের ত্রূটি যা আবহমানসংক্রান্ত পাঠ প্রভাবিত করে, সেই খুঁত বাতিল করার জন্য ইউরোপে ব্যবহৃত সূত্র, রাধানাথের অজানা ছিল। সুতরাং, রাধানাথ তাঁর বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে, ৩২°ফারেনহাইট (০°সেলসিয়াস) এ ব্যারোমিটার পাঠ কমানোর জন্য, নিজের সূত্র উদ্ভাবন করেন। সূত্রটি তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল জার্নাল(Asiatic Society of Bengal Journal)-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে উপস্থাপন করেন। ১৮৫৭ থেকে ১৮৬২ পর্যন্ত তিনি আবহাওয়াবিজ্ঞান বিভাগের ‘আবহবিদ্যা এবং পদার্থবিজ্ঞান কমিটিতে’ সদস্য ছিলেন। রাধানাথ ১৮৬২ সালে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন এবং পরে জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন গণিত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হন। যার বর্তমান নাম ‘স্কটিশ চার্চ কলেজ’। ১৮৫৪ সালে তিনি ও তার ডিরোজিয়ান বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্র “মাসিক পত্রিকা” নামক মহিলাদের শিক্ষাবিষয়ক পত্রিকাটি চালু করেন। তিনি প্রথাগত ধরন ছেড়ে, একটি সহজ এবং বিশৃঙ্খলমুক্ত শৈলীতে লিখতেন।
গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক সারভে(GTS) সংক্রান্ত কার্যক্রমের ব্যাপারে ব্রিটিশ সংসদের বক্তব্য ছিল -“শুধুমাত্র উপ-সহকারী নয়, কর্তব্যনিষ্ঠ, উদ্যোগী এবং অনলস পরিশ্রমী মানুষেরা, যারা জরিপ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত, নাগরিক প্রতিষ্ঠানের এমন গঠন করেছেন, যা আর কোথাও দেখা যায় না। তাদের সাফল্যের অংশীদার, ভারতের শিক্ষাব্যাবস্থা। এঁদের মধ্যে দক্ষতার জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হিসাবে, উল্লেখ করা যেতে পারে, বাবু রাধানাথ শিকদারের নাম, যিনি একজন ভারতীয়, যার গাণিতিক নিষ্কাশন, সর্বোচ্চ সাফল্য লাভ করেছে।”
২০০৪ সালের ২৭ জুন তারিখে ভারতের ডাক বিভাগ চেন্নাইয়ে ভারতের ত্রিকোণমিতিক জরিপের প্রতিষ্ঠার স্মরণে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে, যাতে রাধানাথ শিকদার ও নইন সিং এর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে।
১৮৭০ সালে ১৭ মে এই বিখ্যাত গণিতবিদের দেহাবসান হয়। তাঁর এইসব বিখ্যাত কাজ-কর্মের জন্যে তিনি আজীবন ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। সেইসঙ্গে, তুষারাবৃত হিমালয়ের উচ্চতা ২৯০০২ ফুট নির্ণয় করে দেশবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এই প্রচেষ্টা বিজ্ঞান সাধনারই ফল। তাই রাধানাথ শিকদারকে বিজ্ঞানী বলা অযৌক্তিক নয়। গণিত বিজ্ঞানের একটি দিককে তিনি দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছেন ।