ইঞ্জিনিয়ার, গণিতজ্ঞ, গায়ক চমক হাসানের সফলতার গল্প

ইঞ্জিনিয়ার, গণিতজ্ঞ, গায়ক সব কিছুতেই পটু চমক হাসানের চমকের গল্প

আরও পড়ুন

পেশায় চমক হাসানএকজন ইঞ্জিনিয়ার। তড়িৎ প্রকৌশলী। পড়াশোনা বুয়েটে। সেখানে স্নাতক শেষ করে এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলিনাতে মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করছেন। তাঁর মতো এরকম ইঞ্জিনিয়ার তো ভুরি ভুরি রয়েছে, কিন্তু চমক হাসান এদের মধ্যে অনন্য কেন? জেনে নিই তাঁর কথা।

গণিতের প্রতি চমকের একটা অদ্ভুত প্যাশন রয়েছে। ছাত্র ছাত্রীরা যাতে গণিতকে ভয় না পেয়ে ভালোবেসে আনন্দ নিয়ে পড়ে তার জন্য ২০১২ সালে চমক ‘গণিত রঙ্গ’ নামক একটি সিরিজ তৈরি করেছিলেন ইউটিউবে। এরপর ‘চটপট গণিত’ নামে আরও একটি সিরিজ তৈরি করেন, যেটা মূলত প্রশ্ন উত্তর নিয়ে। গণিত আর বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর নিজস্ব একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। তাতে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় ৬৩ হাজার। চমক হাসান গণিত অলিম্পিয়াডের একজন প্রথম সারির উদ্যোক্তাদের মধ্যেও একজন৷ তাঁর গণিত নিয়ে লেখা বই ‘গণিতের রঙ্গে হাসিখুশি গণিত’ বইটি বইমেলা বেস্ট সেলার লিস্টে জায়গা করে নেয়। গণিত সম্পর্কে চমকের কথায়, “গণিত নিয়ে আমার জ্ঞান তেমন গভীর নয়, কিন্তু গণিতের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে কোনও সন্দেহ বা কমতি নেই। আমার মনে হয়, এই ভালোবাসাটুকু প্রত্যেকের অনুভব করা উচিত। গণিত আমার বুঝতে এবং বোঝাতে সবসময়ই ভালো লাগত। ২০০৫ সালে বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডে যুক্ত হওয়ার পর ২০০৬ সালে সুব্রত দেবনাথ দা আমাকে জাতীয় গণিত ক্যাম্পে ক্লাস নেওয়ার সুযোগ করে দেন। ওখানে পড়ানোর অভিজ্ঞতা দারুণ।”

ছোটবেলা থেকেই চমক বিভিন্ন বক্তৃতা, বিতর্ক, অভিনয়, রচনা প্রতিযোগিতায় যোগদান করতেন, ফলত অনেক মানুষের সামনে কথা বলতে তাঁর জড়তা নেই একেবারেই। নিজেকে নিয়ে বরাবর এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসেন তিনি। একটা সময় তিনি দিনে ১০ ঘণ্টা করে ক্লাস নিয়েছেন। যদিও তা বাধ্য হয়ে বা অর্থাভাবের কারণে নয়, পড়ানোর প্রতি অসম্ভব ভালোলাগা থেকেই তিনি এটি করতেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত স্নাতক কার্টুনিস্ট ল্যারি গনিক এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক মার্ক হুইলিস-এর লেখা ‘এ কার্টুন গাইড টু জেনেটিক্স’ বইটি তাঁকে বিশেষ অনুপ্রাণিত করে। এই বই পড়ার পর জেনেটিক্স নিয়ে চমক নিজের মতো করে সহজবোধ্য ভাষায় লিখে ফেললেন একটি সুপাঠ্য বই, নাম দিলেন ‘গল্পে জল্পে জেনেটিক্স’।

চমকের জন্ম হয় ১৯৮৬ সালের ২৮ জুলাই বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ায় মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুলজীবন শুরু এবং উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন দেশে থেকেই। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা, শেখার ইচ্ছে, নিজের জানা জিনিসগুলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ভালোবাসেন তিনি। আর ভালোবাসেন গান গাইতে। কুষ্টিয়ার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছেন চমক। স্কুলের মঞ্চে কখনও না গাইলেও বন্ধুদের সঙ্গে বসে বিভিন্ন গানে গলা মেলাতেন তিনি। গানের প্রতি ভালোবাসা, আর ইচ্ছে অনুভব করেন ক্লাস নাইন টেনে পড়াকালীন। বন্ধু তন্ময়ের কাছ থেকে গানের স্কেল, সুরের ধারণা সম্পর্কে শেখেন। এমনিতে চমক ছোটবেলা থেকে মুখে মুখে প্যারোডি গান বানাতে পারতেন। বুয়েটে পড়তে আসার পর প্যারোডি গান দিয়েই চমকের গানের যাত্রা শুরু হয়। গান লিখতে ভালোবাসেন ছোটবেলা থেকেই, ক্লাস সেভেনে তিনি প্রথম গান লেখেন।

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে খাবার টেবিলে বসে তিনি একটি গান লেখেন এবং তাতে সুর দেন, এবং ফেব্রুয়ারী মাসে সেই গানটি তিনি ইউটিউবে আপলোড করেন। সেই সময়েই গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এরপরে একটি লাইভ অনুষ্ঠানে তাঁর স্ত্রী বহ্নি এবং কন্যা বর্ণমালার সঙ্গে তিনি এই গানটি পরিবেশন করেন এবং সেটি বেশ ভাইরাল হয়। সহজ সরল কথা এবং সহজ সুরে গান বাঁধেন চমক। প্রেম, খুনসুটি, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা সবটাই মিলেমিশে এই গান। বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী জিনিয়া সেন তাঁর সেই গানটি শোনেন, শুনে মুগ্ধ হন৷ তারপর টলিউডের বিখ্যাত চিত্র পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় চমকের সঙ্গে যোগাযোগ করে লস অ্যাঞ্জেলসে থাকা তাঁর এক বন্ধু বাবলি চক্রবর্তীর মাধ্যমে। শিবপ্রসাদ ও নন্দিতা প্রযোজিত এবং অরিত্র মুখার্জি পরিচালিত ‘বাবা বেবি ও’ ছবির জন্য তিনি চমকের ওই গানটি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক বলে জানান। রাজি হয়ে যান চমকও। তারপর তো বাকিটা ইতিহাস। বর্তমানে সবাই গুনগুন করতে থাকে সেই বিখ্যাত গান, ‘এই মায়াবী চাঁদের রাতে’…

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান উইন্ডোজের সঙ্গে তাঁর আরও দুটি সিনেমায় কাজ করার কথা রয়েছে। বাংলা ঢোল প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের জন্যও গান গেয়েছেন চমক। তবে, পেশাগতভাবে কোনদিনই গানকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি তিনি, এই গানের অফার তাঁর কাছে উপরি পাওনার মতো। গান নিয়ে খুব বড়ো কিছু পরিকল্পনা নেই তাঁর। মনের আনন্দে গাইতে ভালোবাসেন। তাঁর কথায়, “গান আমার হৃৎপিণ্ডের একটা অংশ, নিজের মতো করে গান গেয়ে যাব। একটা অ্যালবাম নিশ্চয়ই বের করব কোনও এক সময়। নিশ্চিত সেটা ফ্লপ অ্যালবাম হবে! তবে, আমার পরিবারের পরের প্রজন্ম নিশ্চয়ই অনুপ্রাণিত হবে সেটা দেখে৷ আমি বড় স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি, কিন্তু খুশি হই খুব অল্পতেই।”

তরুণ প্রজন্মকে উদ্দেশ্য করে চমক বলেন, “তাঁরা কি করতে চায়, তা প্রথমেই ঠি

 করে নিতে হবে তাঁদের। তারা যা করতে চায় সেই কাজটা আমাদের দেশে এবং সারা বিশ্বে কোথায় কিভাবে হচ্ছে সেটা জানতে হবে, বুঝতে হবে। আগে যারা এই জাতীয় কিছু করেছে, তারা কিভাবে শুরু করেছে, তাদের কি কি সমস্যায় পড়তে হয়েছে, কিভাবে সমাধান বের হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে৷ তাহলে, ধীরে ধীরে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়বে। ‘আমি কেন পারব না’ এই আত্মবিশ্বাস যখন চলে আসবে তখন একটু পরিকল্পনা করে উদ্যোগ নিয়ে নিতে হবে। কোনও অবস্থাতেই হতাশা বেশিক্ষণ ধরে রাখা উচিত নয়। তাদের ছোট ছোট উদ্যোগ এবং সেখানে ছোট ছোট সাফল্য দেশকে সমষ্টিগত ভাবে বহুদূর নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।”

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close