কেএফসি (KFC) পছন্দ করেন না এমন মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু, জনপ্রিয় কেএফসি-র প্রতিষ্ঠা কবে, কে তার প্রতিষ্ঠাতা, কি তার ইতিহাস সেই বিষয় অনেকের কাছেই অজানা। কেএফসি-র পূর্ণ শব্দ হল কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন (Kentucky Fried Chicken)। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন কলোনেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স, যিনি প্রথম দিকে রাস্তার পাশের রেঁস্তোরায় ভাজা মুরগি বিক্রি করা শুরু করেছিলেন। মাত্র ৫ বছর বয়সে কর্নেল তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর অসংখ্যবার নানা কাজে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কিন্তু, তাই বলে নিরাশ হয়ে থেমে থাকেননি তিনি।
কোনও কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই কি সাফল্য আসে! নিশ্চয়ই নয়। সফলতা রাতারাতি অর্জন করা যায় না। তার জন্য দরকার পরিশ্রম, ইচ্ছেশক্তি, আত্মবিশ্বাস। এখনও পর্যন্ত আমাদের পৃথিবীতে যেসব মানুষের নাম সাফল্যের তালিকায় রয়েছে, তাঁরা প্রত্যেকেই জীবনে ব্যর্থতার পাহাড় ডিঙিয়ে সাফল্যের শিরোপা অর্জন করেছেন৷ তাঁদের সফলতার পিছনে রয়েছে বিরাট ভাঙা গড়ার ইতিহাস।
কলোনেল তাঁর দীর্ঘ জীবনে বার বার ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি রেলওয়ের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন একজন বীমাকর্মী হিসেবে। কিন্তু, এগুলির কোনওটাতেই তেমন মন বসেনি তাঁর৷ ১৯২০ সালে নিজের কিছু জমানো পুঁজি দিয়ে বোট কোম্পানি খুললেন। তারপর যোগ দিলেন ইন্ডিয়ানার চেম্বার অফ কমার্সে। তাও মনপসন্দ হল না তাঁর। ছেড়ে দিলেন ওখানকার চাকরি। এরপর কেন্টাকিতে একটি টায়ার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে একজন সেলসম্যান হিসেবে নিযুক্ত হলেন কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই কোম্পানিও বন্ধ হয়ে গেল ১৯২৪ সালে।
এরপর কেন্টাকির স্ট্যান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির ম্যানেজারের সঙ্গে কলোনেলের আলাপ থাকার সুবাদে তিনি একটি সার্ভিস স্টেশনে চাকরি জুটিয়ে ফেললেন। কিন্তু ওই যে প্রবাদ আছে, ‘অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়’। সেই কোম্পানিও পথে বসল ১৯৩০ সালে। চল্লিশের কোঠায় এসে পুরোপুরি বেকার হয়ে যান কলোনেল। কিন্তু, স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। নিজে হাতে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের তা সরবরাহ করার কাজ আরম্ভ করলেন। সেখানেও তাঁকে নানা ঘাত প্রতিঘাত, হুমকি মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে।
১৯৫২ সালে তিনি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করলেন তাঁর বহু সাধনার ফসল। তাঁর নিজস্ব রেসিপি ‘কলোনেল কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন’। শেলবিভিলে-তে এবার নিজের একটি রেঁস্তোরা খুললেন এবং সেখানে শুধু তাঁর ফ্রায়েড চিকেনের ডিশটিই পাওয়া যেত৷ লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ল তাঁর নতুন রেঁস্তোরায়। সকলের বেশ পছন্দও হল কলোনেলের অভিনব চিকেনের সেই ডিশ। এমন অবস্থা হল, তিনি বিক্রি করে কুলোতে পারছেন না আর। শুরু করলেন বিভিন্ন শহরে কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেনের শাখা খোলা। প্রথমে আমেরিকা এবং তারপর ধীরে ধীরে বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল কেএফসি।
১৯৫৫-১৯৬৫ এই দশ বছরে চীন, কানাডা সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কেএফসি-র প্রায় ছয়শোর বেশি শাখা খোলা হয়েছিল। এবং তার ব্যবসাও চলছিল রমরমিয়ে। এরপর থেকে তো সাফল্যের তরী বাওয়া শুরু করল মাতাল গতিতে।
কলোনেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্সের জন্ম ১৮৯০ সালে। বাবা উইলবার ডেভিড এবং মা মার্গারেট এন-এর তিন সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। ১৮৯৫ তে তাঁর বাবার জীবনাবসানের পর পুরো পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে মা মার্গারেটের কাঁধে। দিনরাত পরিশ্রম করতেন তিনি দু-মুঠো ভাতের জন্য। আর এদিকে বড় ভাই কলোনেল দেখাশোনা করতেন ছোট ভাইবোনদের। ৭ বছর বয়সে কলোনেল শিখে গিয়েছিলেন রুটি, সবজি বানানো। শুধু তাই নয়, দক্ষতার সঙ্গে শিখে নিয়েছিলেন মাংস রান্নাও। মা কাজ করতেন বাইরে, আর তিনি বাড়ির গোটা দায়িত্ব পালন করতেন। বাবার মৃত্যুর পর এভাবেই সংসারের অভাব অনটনকে জয় করেছেন তাঁরা।
১৯২০ সালে মা মার্গারেট দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ের পিঁড়িতে বসেন উইলিয়াম নামের এক যুবকের সঙ্গে। সেইসময় তাঁদের পরিবার চলে আসে ইন্ডিয়ানার গ্রিনউডে। দ্বিতীয় বাবা উইলিয়ামের সঙ্গে কিছুতেই বনিবনা হচ্ছিল না কিশোর কলোনেলের। ১৩ বছর বয়সে স্কুলজীবনের অধ্যায় শেষ হয়ে যায় তাঁর এবং এরপর পরিবারকে চিরবিদায় জানিয়ে তিনি চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানাপোলিসে। সেখানে ঘোড়ার গাড়ি রঙ করার কাজে নিযুক্ত হন। ১৪ বছর বয়সে দক্ষিণ ইন্ডিয়ানার ফার্মহ্যান্ড হিসেবে কাজ করেন বছরখানেক।
এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে কিছুদিনের জন্য চাকরি করেন তিনি। ১৭ বছর বয়সে পরপর ৪টি চাকরি ক্ষেত্র থেকে বিতাড়িত হন তিনি। ১৮ বছর বয়সে ছন্নছাড়া জীবনকে গুছিয়ে নিতে জোসেফাইন কিং-এর সঙ্গে আবদ্ধ হলেন বিবাহবন্ধনে। ১৯ বছর বয়সে প্রথম বাবা হলেন তিনি। একটি পুত্র এবং দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয় কলোনেল এবং জোসেফাইনের পরিবারে। ১৯৩২ সালে তাঁদের একমাত্র পুত্র জুনিয়র হারল্যান্ড টনসিল ইনফেকশনে মারা যান। মাঝে ১৯১৬ সালের দিকে কলোনেল পেনসিলভেনিয়ায় তাঁর মায়ের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে দিনমজুরেরও কাজ করেছেন কিছুদিন।
নিজের রেঁস্তোরা চালু হওয়ার পর ১৯৩৫ সালে তাঁকে ‘কেন্টাকি কলোনেল’ উপাধিতে ভূষিত করেন তৎকালীন কেন্টাকি গভর্নর রুবি ল্যাফন। ১৯৩৯ সালের জুলাই মাসে নর্থ ক্যারোলিনাতে একটি মোটেল নেন কলোনেল। ভাগ্যের পরিহাস, ওই বছরেই নভেম্বর মাসে বিধ্বংসী আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে যায় মোটেলটি। ১৯৪০ সালে ফের সেটি পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করেন তিনি। তাতে ভালো সাড়া পেলেন তিনি। কিন্তু, ১৯৪১-এ যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবলে পড়ায় এই মোটেলটিও বন্ধ করে দিতে হয় তাঁকে। ১৯৪২ সালে নর্থ করবিন রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড মোটেলটি বিক্রি করে দেন তিনি। ১৯৪৭-এ কলোনেল দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন ক্লদিয়াকে। বলা চলে, দ্বিতীয় স্ত্রী ক্লদিয়ার অনুপ্রেরণাতেই প্রত্যেকটি প্রতিকূল পরিস্থিতিকে জয় করতে পেরেছিলেন কলোনেল।
একটি ছোটখাটো ক্যাফেতে রান্নাবান্না এবং বাসন মাজার কাজ করতেন কলোনেল। জীবনের ৬৫ টি বছর এভাবেই কেটে গেল তাঁর। সমস্ত কাজ থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি সরকারি ভাতা হিসেবে মাত্র ১০৫ ডলার পান। এইটুকু অর্থ দিয়ে কিভাবে বাকি জীবনটা কাটাবেন তা ভাবতে গিয়ে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। সুইসাইড নোট লিখতে গিয়ে থমকে যান। জীবন তাঁকে আরেকবার নতুন করে বাঁচার তাড়না জোগায়। তখনই মাথায় এল রন্ধনশিল্পের কথা।
৮৭ ডলার খরচ করে কিনলেন রান্নার যাবতীয় সামগ্রী। নিজের বিশেষ রেসিপি ফ্রায়েড চিকেনের হোম ডেলিভারি দিতে শুরু করেন বিভিন্ন জায়গায়। ১০১০তম বার চেষ্টার পরে তাঁর চিকেন রেসিপির লাইসেন্স হয়। কর্মক্ষেত্রে হাজারো ত্যাগ, অপমান, ওঠা পড়া, আর অমানুষিক পরিশ্রমের পর তিনি জীবনের শেষ অধ্যায়ে ৮৮ বছর বয়সে এসে সফলতা অর্জন করেন। আসলে, যে কোনও কাজে সফলতা পেতে চাইলে চাই অসীম ধৈর্য, কাজের প্রতি মনোযোগ এবং লেগে থাকা, তবেই কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।