আজ মিলখা সিং ওরফে ফ্লাইং শিখের প্রয়াণ দিবস, কুর্নিশ তাঁর জীবনসংগ্রামকে

আজ কিংবদন্তী ট্র‍্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ক্রীড়াবিদ মিলখা সিং-এর প্রয়াণবার্ষিকী। তাঁর জীবন যুদ্ধ, অদম্য লড়াই, অসীম ধৈর্য্যশক্তিকে স্যালুট। তাঁর সাফল্যের কাহিনী অনুপ্রাণিত করে যুব সমাজকে।

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশিষ্ট স্বর্ণপদক জয়ী প্রথম ভারতীয় ট্র‍্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ক্রীড়াবিদ মিলখা সিং-এর আজ প্রয়াণ দিবস। গত বছর ২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও, করোনার পরবর্তী জটিলতার কারণে প্রাণ হারান ৯১ বছর বয়সী মিলখা সিং ওরফে ‘ফ্লাইং শিখ‘। এই নাম অর্জন করার নেপথ্যের কাহিনীটা মোটেই সহজ ছিল না। জীবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বেঁচেছেন মিলখা সিং। তাঁর জীবনযুদ্ধ সত্যিই কুর্নিশযোগ্য।

মিলখা সিং জন্মেছিলেন ১৯২৯ সালের ২০ নভেম্বর অবিভক্ত ভারতের এবং এখনকার পাকিস্তানের মুজফফর জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। তাঁর পরিবার ছিল শিখ রাজপুত। মোট ১৫ জন ভাইবোন ছিলেন মিলখারা। জন্মের পর থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কি জিনিস, তা প্রতিদিনের ছবি হয়ে গিয়েছিল মিলখার চোখে। মিলখার যখন ১৮ বছর বয়স, তখন চলছে দেশ ভাগাভাগির সময়। চরম অশান্তি, চারদিকে রক্তবন্যা, মৃতদেহ সে এক বিভীষিকাময় সময়। এই অশান্তির মধ্যেই একদিন মিলখার চোখের সামনে তাঁর বাবা মা এবং সাত ভাইবোনকে মেরে ফেলা হয়।

মৃত্যুপথযাত্রী মিলখার বাবা তখন মিলখাকে ডেকে বলেছিলেন যদি প্রাণে বাঁচতে হয় তাহলে ‘ভাগ মিলখা ভাগ’। জেদ চেপে গিয়েছিল সদ্য সাবালক মিলখার। চলে এসেছিলেন ভারতে। সেসময় দিল্লিতে তাঁর এক দিদি থাকত। সেই দিদির কাছেই গিয়ে আশ্রয় নিলেন মিলখা। দারিদ্র্যতা, অনাহার প্রতিদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খেত তাঁকে। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল মিলখার জীবন। তবে হ্যাঁ, ওই দারিদ্র্য, না খেয়ে দিনের পর দিন কাটানোর সময়গুলোই পরবর্তী জীবনে তাঁর কাছে আশীর্বাদ হয়ে ফিরে এসেছে।

একদিকে বাবা মাকে অকালে হারানোর শোক, তারপরে ক্ষুধার তীব্র জ্বালায় মিলখা কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কুচিন্তা আসে তাঁর মনে। প্রথম জীবনে ডাকাত হতে চেয়েছিলেন। অপরাধ করেই ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা মেটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি। তবে, কার্যত তা তিনি করেননি। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করবার। কিন্তু, ভাগ্য সাথ দিল না। ফের একবার চেষ্টা করলেন ১৯৫০ সালে। কিন্তু না, সেবারও পেলেন না। এমতাবস্থায় হতাশ হয়ে একটি রবারের কারখানার শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত হলেন মিলখা।

কিন্তু, তাই বলে চেষ্টা থামাননি সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য। ১৯৫২ সালে চতুর্থ বার চেষ্টার পর মিলল সাফল্য। মাসিক ৩৯ টাকা ৮ আনা বেতনে যুক্ত হলেন ভারতের সেনাবাহিনীতে। সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত থাকার সময় তিনি বিভিন্ন স্পোর্টস ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ছোটবেলা থেকেই দৌড়, খেলাধুলোর প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল মিলখার। তার প্রমাণ, সেনাবাহিনীর কোনও জওয়ানই মিলখার সঙ্গে দৌড়ে পেরে উঠত না। সব্বাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতেন তিনি। এই বিষয়টা তৎকালীন সেনা কর্তাদের নজরে আসে। আর, সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর দৌড়বিদ জীবনের যাত্রা।

সাল ১৯৫৬। অলিম্পিকের আসরে নাম লেখালেন মিলখা। মেলবোর্ন গেমস। প্রথম রাউণ্ডেই খেলা থেকে বেরিয়ে যান তিনি। হতাশ হননি। ওই বছরই ফের এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করে ২০০ এবং ৪০০ মিটারে সোনার মেডেল জিতে ফিরলেন। জয়জয়কার চারিদিকে। এর দুই বছর পর ১৯৫৮ সালে কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নিলেন তিনি। তাতে প্রথম ভারতীয় হিসেবে কমনওয়েলথে শুধু স্বর্ণজয়ীই হলেন তা নয়, এমন এক রেকর্ড গড়ে তুললেন যা ৫২ বছর ধরে মানুষ মনে রাখল। মাত্র ৪৬.৬ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে আফ্রিকার স্প্রিন্টার ম্যালকম স্পেন্সকে হারান তিনি। এ এক অভাবনীয় বিষয়।

এরপর ১৯৬০ সালে যোগদান করলেন রোম অলিম্পিক গেমসে। সেখানে চতুর্থ স্থান অধিকার করে নিজের ৪০০ মিটার দৌড়ের রেকর্ড নিজেই ভাঙলেন মিলখা। আরও কম সময়ে ৪৫.৭৩ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করেছিলেন তিনি। তাঁর এই দীর্ঘ জীবনে একবার জেলেও যেতে হয়েছিল মিলখাকে। একবার বিনা টিকিটে ট্রেনে যাত্রা করার জন্য তাঁকে তিহার জেলে বন্দী করা হয়। জামিনের জন্য বিরাট অর্থ জরিমানা দিতে বলা হয় তাঁকে। কিন্তু, কোথায় পাবেন সেইসময় অত টাকা! বাধ্য হয়ে মিলখার দিদি তাঁর সমস্ত গয়না বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে মিলখাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।

১৯৬২ সালে এশিয়ান গেমসে ৪০০ মিটার দৌড় এবং ৪০০ মিটার রিলে রেসে সোনা জেতেন তিনি। এরপর ১৯৬৪ সালে কলকাতা ন্যাশনাল গেমসেও ৪০০ মিটার দৌড়ে রৌপ্যপদক জয়ী হন। সেই বছরই ভারতীয় মহিলা দলের প্রাক্তন অধিনায়ক নির্মল কৌরকে বিয়ে করলেন মিলখা। জীবনের সেরা দৌড়টা তিনি দৌড়েছিলেন পাকিস্তানের মাটিতে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান মিলখার দৌড় দেখে আদতে বিস্মিত হন। মিলখার দৌড়ে অভিভূত হয়ে খেলার শেষে তিনি মিলখার মাথায় হাত রেখে বলেন, ‘ফ্লাইং শিখ’। পরের দিনই খবরের কাগজে মিলখার ছবি এবং তার নীচে লেখা ‘ফ্লাইং শিখ’ প্রকাশিত হল।

২০০১ সালে মিলখা সিংকে অর্জুন পুরস্কারে সম্মানিত করার জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। কিন্তু, সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন – “অনেক বছর বাদে সরকারি স্বীকৃতি পেলাম। এই স্বীকৃতির দরকার নেই আমার। বহু জায়গায় বহু সাধারণ মানুষের আন্তরিকতা এবং ভালোবাসা পেয়েছি আমি। এটাই আমার জীবনের পরম পাথেয় হয়ে থাকবে আগামীতে।”

এরপর ২০১৭ সালে বিশ্বের বিখ্যাত মিউজিয়াম মাদাম তুসোতে মিলখা সিং-এর মূর্তি স্থাপন করা হয়। সেই মূর্তি দেখতে যান মিলখা। প্রশংসা করেন এর স্থপতিকে। দৌড়ের ভঙ্গিমায় ছবিও তোলেন নিজের মূর্তির সঙ্গে। ২০১৮ সালে এই কিংবদন্তী অ্যাথলিটকে সম্মান জানাতে ‘খেল রত্ন‘ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এক কথায় ভারতীয় স্পোর্টসের ভবিষ্যৎকে এক অন্য আলোর দিশা দেখিয়ে গিয়েছেন মিলখা সিং।

২০১৩ সালে মিলখা সিং-এর জীবনী নিয়ে পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরাভাগ মিলখা ভাগ‘ নামক একটি জীবনীমূলক চলচ্চিত্র তৈরি করলেন। ছবিতে মিলখা সিং-এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশিষ্ট অভিনেতা ফারহান আখতার। ছবিতে নিজের জীবন সংগ্রাম দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন মিলখা সিং। কিংবদন্তী এই ফ্লাইং শিখের অদম্য লড়াই তাঁকে ব্যর্থতার অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসেছে। তাঁর জীবনযুদ্ধ আদর্শ হয়ে থেকে যাবে কোটি কোটি মানুষের মনে।

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close