তিনি অতুলনীয়, চিরপ্রণম্য বর্ধমানের সদাই ফকির

বছরে ২ টাকা সাম্মানিকের বিনিময়ে ৩৫০ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান করে চলেছেন পদ্মশ্রী প্রাপ্ত সদাই ফকির ওরফে সুজিত চট্টোপাধ্যায়। তাঁর শিক্ষাতেই শিক্ষিত হচ্ছে বর্ধমানের আউশগ্রাম।

আরও পড়ুন

তাঁর পাঠশালার দরজায় লেখা ‘লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির’। ঘরের লাগোয়াই এক লম্বা বারান্দা, মাথার ওপর টালির ছাদ। সেই বারান্দায় সারি বেঁধে বসে আছে একাধিক শিক্ষার্থীরা। আর তাদের মাঝে একটি চেয়ারে বসে রয়েছেন এক অশীতিপর বৃদ্ধ। তাঁর পরনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি, চোখে চশমা। বয়স ৭৭। সকাল সন্ধ্যে তিনি পড়িয়ে চলেছেন কিশোর কিশোরী এবং তরুণ তরুণীদের। তাঁর জীবনের ব্রত জ্ঞান দান, সমাজ গঠনে তিনি চির প্রত্যয়ী। তাঁর যাপন বিশ্বাস করায়, সংকল্পে যদি স্থির থাকা যায় তাহলে পাহাড় ডিঙোনোও সম্ভব। তিনি বর্ধমানের সদাই ফকির ওরফে সুজিত চট্টোপাধ্যায়

সদাই ফকির ওরফে সুজিত চট্টোপাধ্যায়

তিনি পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের উত্তর রামনগর গ্রামের বাসিন্দা। গত ১৯৬৫ সালে তিনি নিজের গ্রামেরই রামনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগদান করেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন প্রায় দেড় দশক হয়ে গেল। অবসর অবশ্য শিক্ষকতা থেকে নয়, স্কুল থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন বলা চলে। তাঁর শরীর এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। কিন্তু, আজও জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসেও গ্রামের ছেলেমেয়েদের অক্লান্ত ভাবে শিক্ষাদান করে চলেছেন তিনি।

নিজের সঞ্চয়ের অর্থব্যয় করে এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে তাই নিজের বাড়ির বারান্দাতেই গড়ে তুলেছেন ‘সদাই ফকিরের পাঠশালা’। সেখানে নবম, দশম শ্রেণী থেকে শুরু করে স্নাতক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের পড়ান সুজিত বাবু। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০০ জন ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে নিয়মিত পড়তে আসে। সকলেই দুঃস্থ ঘরের ছেলেমেয়ে। ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি তার মধ্যে। তাঁরা বেশিরভাগই গ্রামের শুদ্র, মোল্লা এবং সাঁওতাল জাতির।

শিক্ষাদানে রত সুজিত বাবু

দীর্ঘ বছর ধরে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় তিনি উপলব্ধি করেছেন, সমাজে মেয়েদের এখনও নানা প্রতিকূলতা রয়েছে। বিশেষত, সমাজের পিছিয়ে পড়া গরীব এবং প্রান্তজ শ্রেণীর মেয়েদের। তাই তাদের মধ্যে শিক্ষার উৎকর্ষতা বাড়িয়ে সুশিক্ষিতা করে তোলার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এই নিরলস পাঠদানের বিনিময়ে তাঁর উপার্জনের গল্পটা শুনলে মনে হবে আজও পৃথিবীতে এই ধরনের গুটিকয়েক মানুষ আছেন বলেই মানবিকতা হারিয়ে যায়নি। ছাত্রছাত্রীদের সারাবছর পড়িয়ে তিনি তাদের কাছ থেকে বছরে মাত্র ২ টাকা নেন। আর ছাত্রছাত্রীরা বছর শেষে তাঁকে উপহার দেয় চকলেট।

অবাক লাগে তাই না! আগে সাম্মানিক ছিল বছরে ১ টাকা। এ বছর তা বাড়িয়ে ২ টাকা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, “আমার এই এলাকায় যাঁরা প্রাইভেট টিউটর রয়েছেন, টিউশনি করেই যাঁদের সংসার চলে, তাঁরা এসে আমায় ধরেছিল। বলেছিল এমন করলে তো তাঁরা আর ছাত্রছাত্রী পাবেন না। সেইজন্যেই ১ টাকা থেকে ২ টাকা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, এর বেশি যে আমার ছাত্রছাত্রীদের আর দেওয়ার ক্ষমতা নেই।”

তিনি জানান, “২০০৪ সালে স্কুল থেকে অবসর গ্রহণের পর স্কুলেরই একটি ঘরে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু, অনুমতি মেলেনি সেসময়৷ একদিন ৩ জন ছাত্রী এসে অনুরোধ করে পড়ানোর জন্য। তাঁদের অনুরোধ ফেলতে পারিনি। বাড়ির বারান্দাতেই টোল খুলে বসলাম।” সেই ৩ থেকে সংখ্যাটা আজ ৩০০-য় এসে দাঁড়িয়েছে। সদাই ফকিরের পাঠশালায় কিন্তু স্কুলের মতোই নিয়মকানুন বজায় রয়েছে। সকাল ৬টায় শুরু হয় ক্লাস, ওদিকে শেষ হয় সন্ধ্যে ৬টায়।

স্কুলের মতোই রয়েছে রেজিস্ট্রারের খাতা। শিক্ষক-অভিভাবক মিটিংও হয় নিয়ম করে। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। অনেকেই আবার কুড়ি বাইশ কিলোমিটার দূর থেকে সাইকেল চালিয়ে পড়তে আসে। গ্রামে ভালো স্কুল নেই বললেই চলে। একটি কলেজ রয়েছে তাও গ্রাম থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রামে ভালো স্কুলের জন্য সরকারি আধিকারিকদের কাছে বিস্তর চিঠিপত্রও লিখেছেন সুজিত বাবু। কিন্তু, তাতে কোনও কাজ হয়নি।

সুজিত বাবু তাঁর ছাত্রছাত্রীদের পড়ান বাংলা এবং ভূগোল। আর কলেজ পড়ুয়াদের পড়ান বাংলা। তাঁর বিএসসি পাশ নাতি উৎসব প্রতিনিয়ত সাহায্য করেন তাঁকে। সুজিত বাবু বলেন, “ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেউ যদি পরপর দুদিন পড়তে না আসে, তাহলে তিনি নিজেই গিয়ে হাজির হন তাদের বাড়িতে খোঁজ নিতে। বাপ মা দিনমজুরের কাজে লাগালে বকাবকি করে তাঁদের হাতে কিছু টাকাপয়সা গুঁজে দিয়ে আসেন।” কোভিড চলাকালীন লকডাউনের সময়ও তিনি নানাভাবে এই দুঃস্থ মানুষগুলির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে জানান গ্রামবাসীরা।

সুজিত বাবুর পড়াশোনা রামনগর জুনিয়র হাইস্কুলেই। তারপর বোলপুরের বাঁধগড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। স্নাতক পাশ করেন বর্ধমানের রাজ কলেজ থেকে এবং মাস্টার্স করেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিটি পাশ করেন জলপাইগুড়ি থেকে। মাত্র ২২ বছর বয়সে চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন তিনি। গত দু বছর ধরে লকডাউনের সময় গ্রামের কর্মহীন আড়াইশো পরিবারের হাতে চার দফায় ৭৫ হাজার টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী তুলে দিয়েছেন তিনি। এছাড়া গ্রামের ৭ জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর পাশেও দাঁড়িয়েছেন সুজিত বাবু।

পদ্মশ্রী প্রাপ্ত সুজিত বাবু

বর্তমানে তাঁর বাড়িতে রয়েছেন স্ত্রী মীরাদেবী। এক মেয়ে ছিল, তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে৷ এক ছেলে প্রসেনজিৎ চাকরিসূত্রে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে বাইরে থাকেন। কিন্তু, সুজিত বাবু নিজের গ্রাম ছেড়ে দুদিনের জন্যও বাইরে থাকবার কথা ভাবতে পারেন না। নিজেকে ‘ফকির’ই বলেন তিনি। তাঁর কথায়, “আমরা সম্পূর্ণ খালি হাতে পৃথিবীতে আসি। ফিরে যেতেও হয় খালি হাতে। শুধু রয়ে যায় যা, তা হল আমাদের কর্ম।” সকাল থেকে সন্ধ্যা, বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের বিশাল জ্ঞানসমুদ্রে এক ফোঁটা শিশির বিলিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেই ব্রতী হয়েছেন তিনি।

২০২১ সালে ‘পদ্মশ্রী‘ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন সুজিত বাবু। এমন একজন মানুষ যাঁর জীবনে কোনও অভিযোগ নেই, অজুহাত নেই, অর্থের লোভ নেই, অহংকার বোধ নেই। তিনি নিস্পৃহ, তিনি প্রজ্ঞাবান, তিনি ধন্য এবং চিরপ্রণম্য। ভালো থাকুন সদাই ফকির, তাঁর হাত ধরে তৈরি হোক হাজার হাজার ছেলেমেয়ে।

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close