একজন বিখ্যাত সফল মানুষ বলেছিলেন, “যাঁরা অন্যদের নকল করে থাকেন তাঁরা হয়তো কিছু সময়ের জন্য জীবনে সাফল্য পান ঠিকই, কিন্তু জীবনে খুব বেশি দূর এগোতে পারেন না।” এই বিখ্যাত মানুষটির জীবনে সাফল্যের নির্দিষ্ট কিছু বীজমন্ত্র আছে। সেই বীজমন্ত্রগুলি মেনে চলেন বলেই, আজ ভারতবর্ষের তথা সমগ্র বিশ্বের অন্যতম সফল একজন শিল্পপতি হলেন রতন টাটা। যিনি কেবলমাত্র নিজেই সফল নন, তাঁর সফল জীবনের গল্প অনুপ্রেরণা জোগায় হাজার হাজার মানুষকে একটি উচ্চমানের এবং উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে।
ভারতের অন্যতম সর্ব বৃহৎ এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান টাটা৷ বর্তমানে বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের প্রায় ১০০টি দেশে শতাধিক কোম্পানির মাধ্যমে টাটা প্রতিষ্ঠানের ব্যাবসা পরিচালিত হচ্ছে৷ ভারতের এই অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপের সঙ্গে জীবনের অর্ধশত বছর অতিবাহিত করে গত ২০১২ সালে অবসরে যান রতন টাটা। সেই সময় এই নামী প্রতিষ্ঠানটির মোট আয় ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
টাটা গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৮৬৮ সালে এবং ১৯৯১ সালে রতন টাটা সেই গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন। তারপর থেকেই ম্যাজিকের মতো বদলে যায় পুরো গল্পটা। সেই সময় মুক্তবাজার অর্থনীতির সুবিধা পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে টাটার লাভের পরিমাণ এক লাফে ৫০ গুণ বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হন রতন টাটা। মোটরগাড়ি নির্মাণ করা থেকে শুরু করে সফটওয়্যার, স্টিল, বেভারেজ ইত্যাদি প্রথম সারির বহু ব্যবসায় অর্থ বিনিয়োগ করে তিনি এবং বহু ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে মজবুত ভিত তৈরি করে দেন। তাঁর হাত ধরে টাটা একটি বৃহত্তর বাণিজ্যিক সংস্থা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী এবং পরিচিত ব্র্যান্ডের তালিকায়। বিশ্বখ্যাত গাড়ির ব্র্যান্ড জাগুয়ার, টেটলি, এ্যান্ড রোভার এবং কোরাস অধিগ্রহণ করার ক্ষেত্রে রতন টাটা যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা টাটা গ্রুপকে একটি বড় ভারতকেন্দ্রিক সংস্থা থেকে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডে পরিণত করেছিল।
ভারতের অন্যতম এই সফল শিল্পপতির স্যার রতন টাটার জন্ম হয় ১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুম্বাই শহরে৷ রতন টাটার বাবা নাভাল টাটাকে দত্তক নিয়েছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যার জামশেদজী টাটার নিঃসন্তান ছোট ছেলে। তাঁর মায়ের নাম সোনি টাটা। নাভাল টাটা বিবাহ করেছিলেন দুবার৷ ১৯৪০ দশকের মাঝামাঝি পৃথক হয়ে যান রতন টাটার বাবা মা। তখন রতন টাটার বয়স মাত্র দশ। বাবার দ্বিতীয় বিবাহের পর তাঁর মা সোনি টাটা এতটাই অসহায় হয়ে পড়েন যে, রতন টাটার আশ্রয় হয় ”জে.এন. প্রিতিত পার্সি’ নামক একটি অনাথ আশ্রমে।
সেখান থেকে এই অসহায় শিশু এবং তাঁর মাকে ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে নিয়ে আসেন দাদি লেডি নাভাজবাই৷ মুম্বাইয়ের একটি প্রাথমিক স্কুলেই শিক্ষালাভ করেন রতন টাটা। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন ক্যানন স্কুল থেকে। এরপর পড়াশোনা করেছেন আর্কিটেকচার, স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। ১৯৭৫ সালে অ্যাডভান্স ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়েছেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর টাটা গ্রুপের সঙ্গে কর্মসূত্রে তাঁর পরিচয় ঘটে ১৯৬১ সালে। কাজ শুরু করেন টাটা স্টিলে। শুরুতে তিনি ব্লাস্ট ফার্নেস সরানোর কাজ করতেন। ১৯৯১ সালে রতন টাটার মেধা এবং পরিশ্রম করার মানসিকতার মূল্য দেন জে.আর.ডি টাটা, চেয়ারম্যান পদে বসানো হয় তাঁকে। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এই ঘটনা নিয়ে সমালোচকদের মধ্যে নানা তর্কবিতর্ক শুরু হয়।
পশ্চিমবঙ্গে ন্যানো কারখানা নির্মাণ করতে গিয়ে রতন টাটা বলেন, তিনি অনেক বিষয়েই শিক্ষালাভ করেছেন যা পরবর্তী ক্ষেত্রে তাঁর ব্যবসায় কাজে লেগেছে। মাত্র ত্রিশ হাজার টাকায় শুরু করা ব্যাবসা রতন টাটার হাত ধরে আজ ট্রিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। শতাধিক প্রতিষ্ঠানের বিচরণ আজ ব্যাবসার প্রধান দশটি ক্ষেত্রেই। তার মধ্যে রয়েছে- আইটি, ব্যাংকিং, এরোস্পেস, ওটোমোটিভ, ইলেকট্রনিকস, কেমিক্যাল, খাদ্য, ট্যুরিজম, টেলিকম মিডিয়া এবংটেক্সটাইল।
টাটা গ্রুপই নয়, গ্রুপের বাইরেও বেশ কিছু জায়গায় তিনি বিনিয়োগ করেন। ভারতের অন্যতম ই-কমার্স ওয়েবসাইট Sandal-এ তিনি নিজের বেশ কিছু অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। ২০১২ সালে রতন টাটা অবসর নেওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। রতন টাটা এমন একজন ভারতীয় যিনি ব্যাবসাকে শুধু ব্যাবসা নয়, মানুষের পরিষেবা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বের দরবারে প্রসারিত করেন।
শুধু ব্যাবসায়িক নৈতিকতার দিক থেকে নয়, রতন টাটা একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। নিজের পরোপকারী, সেবামূলক জনহিতৈষী কাজকর্মের জন্য তিনি মানুষের মনে অচিরেই জায়গা করে নিয়েছেন। ২০০০ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত হন রতন টাটা এবং ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন তিনি। এছাড়া বিজনেস অফ পীস এবং এশিয়ান বিজনেস পুরস্কারও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। সাফল্য লাভের কিছু বিশেষ উক্তি দিয়েছেন স্যার রতন টাটা, যা মানুষকে অনায়াসে অনুপ্রাণিত করবে এবং সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে সাহায্য করবে।
তাঁর কথায়, “আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিশ্বাস করি না। আমি প্রথমে সিদ্ধান্ত নিই, তারপরে সেটাকে সঠিক বানিয়ে নিই৷ এমন কিছু বিষয় আছে, যেগুলো আমি আবার সুযোগ পেলে অন্যরকম ভাবে করতে চাই। তবে, আমি আগে কি কি করতে পারিনি, তা আমি পিছন ফিরে দেখতে চাই না। কঠিন সময়ে ঐক্যবদ্ধ থাকাটা আপনাকে সবসময় বেনিফিট দিয়ে থাকে৷ ব্যাবসার ক্ষেত্রে কঠিন সমিয় আসে। কিন্তু, সেই কঠিন সময়ে যদি আপনি এবং আপনার কোম্পানির সঙ্গে জড়িত কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেন, তবে আপনার সাফল্য কখনও আটকাবে না। আপনি দ্রুত বেগে চলতে চাইলে একাই চলুন। আর যদি অনেক দূর যেতে চান, তাহলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে চলুন। কেউ আপনার দিকে পাথর ছুঁড়লে, সেই পাথরকে স্মারক বানানোর কাজে ব্যবহার করুন। জীবন্দ চলার পথে ওঠাপড়া থাকতেই হবে। কারণ, ইসিজি-তে যদি সোজা একটা লাইন আসে, তাহলে বুঝতে হবে যে আমরা আর বেঁচে নেই।”
কোম্পানি থেকে কর্মী ছাঁটাই সম্পর্কে তিনি বলেন, “বিভিন্ন কোম্পানিকে মাঝেমধ্যেই খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। টার্নওভার, লাভের পরিমাণ ইত্যাদি খারাপ হলে অনেক কোম্পানিই কর্মচারী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে শুরু করে৷ কিন্তু, মনে রাখা দরকার কর্মচারী ছাঁটাই কোনও সমাধানের পথ নয়। অত্যধিক কর্মী ছাঁটাই কোম্পানির বদনামের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। টাটার ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা একেবারেই নেই। এই অতিমারিতে যখন একের পর এক সংস্থা কর্মী ছাঁটাই করতে শুরু করছে সেখানে ব্যতিক্রমী থেকেছে টাটা গ্রুপ।”
যিনি নিজের কোম্পানি তৈরি করছেন, তাঁর নিজের সবসময় প্রাসঙ্গিক এবং সমস্ত বিষয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা খুব প্রয়োজন। নাহলে, তাঁর ব্যাবসা কখনওই উন্নতি লাভ করবে না। রতন টাটার সবচাইতে বড় গুণ হল, তিনি নিজের পরিস্থিতি সম্পর্কে সদাই ওয়াকিবহাল। এছাড়া দুনিয়ায় যখন যা ঘটছে, সে সম্পর্কেও তিনি খবর রাখেন সবসময়। তরুণদের সঙ্গে কাজ করতে ভালোবাসেন বরাবর। তরুণ কর্মচারী নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কোম্পানি বিখ্যাত। সেইজন্যেই সাফল্যের দিক থেকে বিচার করলে স্যার রতন টাটা এতটা এগিয়ে।