শ্রীরামপুর রাজবাড়ীর অন্দরের গল্পকথা

শ্রীরামপুর রাজবাড়ী স্মরণ করিয়ে দেয় শত বছরের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। রাজবাড়ীর সেই বিশাল প্রতিপত্তি, রাজকোষ বজায় না থাকলেও বনেদিয়ানায় তার কোনও ছাপ পড়েনি।

আরও পড়ুন

পুরোনো রাজবাড়ী, বনেদি বাড়ি, সাবেকি স্থাপত্যের প্রতি ভালোবাসা, আকর্ষণ অনুভব করেন এমন ভ্রমণবিলাসী মানুষ আছেন অসংখ্য। তাঁরা ফাঁক পেলেই বেরিয়ে পড়েন এসব প্রাচীন, নোনাধরা আভিজাত্য বনেদিয়ানার স্বাদ উপভোগ করতে। তবে, এখন এই আধুনিকতার যুগে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কত দ্রষ্টব্য, কত ইতিহাস কালের নিয়মে হারিয়ে যাচ্ছে। আজ যে অট্টালিকাগুলি আমরা ভগ্নপ্রায় অথচ কি অপূর্ব বলে ব্যাখ্যা করি, সেগুলি পূর্বাবস্থায় আরও কত সুন্দর ছিল তা অনুমান করাই যায়। 

আজ এমনই এক প্রাচীন আমলের রাজবাড়ী নিয়ে টুকিটাকি জানাবো আপনাদের। যাঁরা আজও ইতিহাস, স্থাপত্য, পুরোনো ঐতিহ্য, আভিজাত্যের পৃষ্ঠপোষক তাঁদের কাছে এই রাজবাড়ী স্বর্গসমই মনে হবে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘অপরাজিত‘ ছবির পরিচালক অনীক দত্তের আরেক বিখ্যাত বাংলা ছবি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ‘-এর কথা নিশ্চয়ই ভোলেননি কেউ। সেই ছবির শ্যুটিং হয়েছিল কোথায় জানেন? ওই সিনেমার শ্যুটিং স্পট ছিল হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত শ্রীরামপুর রাজবাড়ী

শ্রীরামপুর রাজবাড়ী

শ্রীরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম দক্ষিণ কোণে এই বিখ্যাত রাজবাড়ীটি অবস্থিত। উল্লেখ্য, ১৭৫৫-১৮৪৫ সাল পর্যন্ত শ্রীরামপুর ফ্রেডরিক্সনগর নামে ডেনিশদের অন্তর্গত ছিল। এই শহর গড়ে ওঠার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ এবং তাতে অবশ্যই শ্রীরামপুরের গোস্বামীদের নাম চলে আসবে। আসলে শ্রীরামপুর রাজবাড়ী এই গোস্বামী পরিবারেরই বাড়ি। শ্রীরামপুর শহরটি গড়ে উঠেছিল তিনটি গ্রামকে একত্র করে, শ্রীপুর, গোপীনাথপুর এবং মোহনপুর। জানা যায়, রাজবাড়ীর এই গোস্বামী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হলেন রামগোবিন্দ গোস্বামী।

এ নিয়ে প্রচলিত এক গল্প রয়েছে। একবার রামগোবিন্দ গোস্বামী তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নৌকায় করে শান্তিপুর থেকে কলকাতার দিকে যাচ্ছিলেন। শ্রীরামপুরের কাছে নৌকা এলে তাঁর স্ত্রীয়ের অসহ্য প্রসব যন্ত্রণা আরম্ভ হয়। ওই নৌকাতেই তিনি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। শ্রীরামপুর তখন শ্যাওড়াফুলির রাজার অধীনস্থ ছিল। আবার ঘটনাচক্রে শ্যাওড়াফুলি ছিল পাটুলির রাজার কাছাড়ি বাড়ি। তো সেই রাজা আবার দান ধ্যানে খুব মন ছিল। রামগোবিন্দ গোস্বামীর পুত্রের জন্মের খবর পেয়েই রাজা মনোহর রায় ওই কাছারি বাড়িটি রামগোবিন্দকে দান করতে চান।

কিন্তু, রামগোবিন্দ সেই দান গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তবে, পরে এক কড়ির বিনিময়ে রাজা মনোহর রায়ের থেকে সেই সম্পত্তি কিনে নেন রামগোবিন্দ বাবু। রামগোবিন্দ গোস্বামীর দুই পুত্র- রামগোপাল এবং রাধাকান্ত। জানা যায়, এই রাধাকান্তের তৃতীয় পুত্র রামনারায়ণ নাকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আসাম প্রদেশের দেওয়ান ছিলেন।

উল্লেখ্য, শ্রীরামপুরের এই রাজবাড়ীটির দুটি আলাদা আলাদা ব্লক আছে। একটি উত্তরে এবং আরেকটি দক্ষিণে। জানা যায়, এই দক্ষিণ ব্লকটি নাকি সম্ভবত হেমচন্দ্র গোস্বামীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। রাজবাড়ীটি মূলত দোতলা। এর একটি অংশ বর্তমানে বিয়ের ভবন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। উত্তরের ব্লকে রয়েছে বিরাট এক গাড়ি বারান্দা। আছে আয়নের কলাম এবং ঢালাই করা বিরাট লোহার ফটক। বর্তমানে উত্তরের ব্লকের একাংশ একটি শিশু গাইডেন্স সেন্টার হিসেবে সরকার কর্তৃক ব্যবহৃত হয়।

রাজবাড়ীর অন্দরে রয়েছে আসল আকর্ষণ। রয়েছে বিরাট চাঁদনি অর্থাৎ নাটমন্দির। বিশালাকার এই রাজবাড়ীর চারদিকে রয়েছে বিশালাকার করিন্থিয়ান থাম। যার উচ্চতা ৩২ ফুট এবং ডায়ামিটার ৫ ফুট। জানা যায়, এই থামগুলি নেপাল থেকে আনা। শালকাঠের কড়ি বরগার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এর ছাদ। আগে বাড়ির দালানের জায়গায় ছিল বিরাট এক পুকুর। সেই পুকুরে ডুবে রাজপরিবারের এক সদস্যের মৃত্যু হওয়ায় পুকুরটি বুজিয়ে নাটমন্দির গড়ে তোলা হয়। রাজবাড়ীর মেঝে তৈরি করা হয়েছে চুনাপাথর দিয়ে। এই রাজবাড়ীর গঠনে মূলত ভারতীয় এবং ইউরোপীয় দুধরনের স্থাপত্যেরই মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।

এই রাজবাড়ীর প্রধান উপাস্য হলেন রাধাগোবিন্দ জিউ-এর যুগল মূর্তি। ঠাকুরদালানের এক পাশে স্থির ভাগ্যদেবতার মতো অবস্থান করেন তাঁরা। এছাড়া, এই রাজবাড়ীর দুর্গাপুজো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জানা যায়, রামগোবিন্দ গোস্বামীই নাকি এই পুজোর প্রচলন শুরু করেন। সেসময় ধুমধাম করে পুজোর আয়োজন হত, শতাধিক মানুষ আসত রাজবাড়ীতে। আগে রাজবাড়ীর নাটমন্দিরে রাসযাত্রা, দোলযাত্রা, ঝুলন সবই হত।

রাজবাড়ীর দুর্গাপুজো

রাজবাড়ীর পরিবারসূত্রে জানা যায়, গোস্বামী বাড়ির দুর্গাপুজোয় বিশাল সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হত প্রত্যেক বছর। সেই সঙ্গীতের আসরে গান গেয়েছেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রা, বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষীর দল। জানা যায়, ঐতিহ্যমন্ডিত এই রাজবাড়ীর দুর্গাপুজোয় উপস্থিত থাকতেন খোদ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু

কালের অমোঘ নিয়মে এখন ভগ্নপ্রায় অবস্থা রাজবাড়ীর। হারিয়ে গিয়েছে বহু প্রাচীন সম্পদ। ঝড়, জলসাঘর, ভূতের ভবিষ্যৎ-এর মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ের সাক্ষী এই শ্রীরামপুর রাজবাড়ী। এই রাজবাড়ীর ভেতরের ছবি তুলতে এখন বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। সামনের ছুটিতেই বেরিয়ে পড়ুন শ্রীরামপুর রাজবাড়ীর চাক্ষুষ দর্শনে। এক অন্যরকম আভিজাত্যপূর্ণ ছোঁয়া পাবেন এই বাড়িতে৷ 

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close