পবিত্র রমজান মাস চলছে। পঞ্চম রোজার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। প্রস্তুতি চলছে শেহরির জন্য। নিয়ম অনুযায়ী এই সময় দুবার খাবার খাওয়া হয়। সকালে সূর্য ওঠার আগে একবার ‘শেহরি’ এবং বিকেলে খাওয়া হয় ‘ইফতার’। দেশ জুড়ে তাতে থাকে বিভিন্ন রকমের নিত্যনতুন সমস্ত খাবার এবং স্থান বিভেদে সেই খাবারের তালিকাও পরিবর্তন হতে থাকে। ইসলাম সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য অনুযায়ী, সকলেই বেশিরভাগ সময় নিজেদের রোজা ভাঙেন জল এবং খেজুর দিয়েই। এবং তাদের পানীয় হিসেবে থাকে শরবত, দুধ। এছাড়া থাকে রুহ আফজা। খাবারের ক্ষেত্রেও দুই ধরনের খাবার অর্থাৎ আমিষ এবং নিরামিষ পদ দুই-ই থাকে। রমজান মানেই নানা ধরনের বাদাম, শুকনো খবার, খেজুর এবং নানা মিষ্টির সমাহার৷ প্রত্যেকটি খাবারই কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিকেলবেলার ইফতারে থাকে সাধারণত একটু মুখরোচক, তেল ঝাল মেশানো রিচ খাবার। থাকে জাঙ্ক ফুড, মাংসের নানারকম পদ। সেগুলো দেখতে যেমন সুন্দর হয়, খেতেও তেমনি লাজওয়াব।
সকালের শেহরিতে থাকে হালকা পাতলা, সহজপাচ্য খাবার। ইফতারে থাকে তার ঠিক উল্টোটা। সারাবছর এই ধরনের মুখরোচক খাবারের চল না থাকলেও, রমজান মাসের এই কটা দিন ইসলাম সম্প্রদায়ের প্রায় সব বাড়িতেই থাকে বিভিন্ন ধরনের কাবাব, হালিম, রেজালা, রোগানজোশ, বিভিন্ন ধরনের ভাজাভুজির পদ। হালিম পদটি বেশি খান হায়দ্রাবাদ এবং দক্ষিণ প্রদেশের মুসলিমরা। আবার, তামিলনাড়ু এবং কেরালার মুসলিমেরা পছন্দ করেন নম্বু কাঞ্জি নামক একটি পদ। যা তৈরি হয় চিকেন, নানা ধরনের সবজি এবং যব সহযোগে।
ধর্মীয় বিধিবিধান থেকে জানা যায়, ইফতারে মুখরোচক খাবারের তেমন কোনও উল্লেখ নেই। ইসলামের ইতিহাসবিদরা বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে উপমহাদেশে আসা এবং শাশন করা বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর নানা ধরনের সংস্কৃতির মতো খাবারও এখন এই অঞ্চলের মানুষের খাদ্য তালিকায় মিশে গিয়েছে। ইসলামিক ইতিহাস এবং সংস্কৃতির এক অধ্যাপকের থেকে জানা যায় যে, ইফতারে যেসব খাবার খাওয়া হয়, তার বড় অংশটি এসেছে পার্সিয়ান বা মুঘল খাবারের তালিকা থেকে। উত্তরের দিকের ইসলাম সম্প্রদায়ের লোকেরা ইফতারে স্ট্রিট ফুড, পকোড়া, ফ্রুট চাট, সিঙ্গারা, ডিমের পদ এসব খাবার বেশি খান। অন্যদিকে আবার, পূর্বের মুসলিমরা মাছ, মুঘল স্বাদের খাবার, তন্দুর খেতে বেশি পছন্দ করেন। তাদের শেষ পাতে থাকে বিভিন্ন মিষ্টির পদ, যেমন- কুলফি, ফিরনি, ফ্রুট ট্রায়ফল, দই ইত্যাদি।
জানা যায়, ইসলামের নবী ইফতারের সময় খেজুর খেতেন। ফলে ইফতারের সময় খেজুর খাওয়াকে সুন্নত বলে মনে করা হয়। এই রীতিটি মধ্যপ্রাচ্য থেকে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। শোনা যায় যে, হজরত মহম্মদ নাকি রোজা ভাঙার সময় খেজুর খেতেন। সেই কারণেই মনে করা হয় যে ইফতারে খেজুর খাওয়াটা একটি ভালো অনুষঙ্গ।
এদিকে ছোলা আবার আফগানিদের প্রিয় খাবারের মধ্যে একটি। তাদের কাছ থেকে ভারতবর্ষের এবং বাংলাদেশের মুসলমানরা এই ছোলা খাওয়ার রীতি গ্রহণ করেছে। তারা কাবুলি চানা বা কাবুলি ছোলা খেয়েছে। শবেবরাতের সময় ছোলার একধরনের হালুয়া তৈরি করা হয়, যেটির নাম হাবশি হালুয়া। এটিও আফগানদেরই একটি পদ। তবে, ভারত এবং বাংলাদেশে সেটা আরও পেঁয়াজ, বিভিন্ন ধরনের মশলা দিয়ে মুখরোচক ভাবে রান্না করা হয়, তার সঙ্গে মুড়ি দিয়ে খাওয়ার চল অবশ্য এই অঞ্চলের নিজস্ব উদ্ভাবন।
মুঘল খাবারের মধ্যে আবার পারসিক খাবারের প্রভাব অনেকটাই বেশি ছিল। তারাই বিরিয়ানি, কাবাব, হালিমের মতো পদগুলি ইফতারে খেত। সেই দেখে এই অঞ্চলের মানুষেরাও এই খাবারের প্রচলন শুরু করে। এখনও বেশ কিছু দেশ, যেমন- ইরান, সৌদি আরব, আরব আমিরাত প্রভৃতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে ইফতারের সময় কাবাব, বিরিয়ানি, এবং পোলাও খাবার চল রয়েছে।
উত্তর ভারত থেকে বাংলাদেশ সহ এলাকাগুলোতে আবার পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ এই ধরনের খাবারগুলো ছড়িয়ে পড়েছে বলে শোনা যায়। ইফতারে শরবত খাওয়ার রীতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি ছাড়াও রয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ভারতে। তেষ্টা মেটাতে জলের পরিবর্তে স্বাদে মিষ্টি এবং সুগন্ধি শরবত খাওয়ার চল প্রচলিত হয়েছে বলে বহু ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
তবে, চিকিৎসকদের মতে, রোজার দীর্ঘ সময় পরে ইফতার করতে হয় বলে ইফতারের খাওয়ারটা যেন হালকা এবং সহজপাচ্য হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। খেজুর দিয়ে ইফতার শুরু করে, ফল এবং নানা ধরনের সবজি খেতে বলেছেন বিভিন্ন চিকিৎসকরা। আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে বাদাম, লাল আটা, ছোলা, বিনস ইত্যাদি জাতীয় খাবার খাওয়া যেতে পারে। ইফতারের পর দুর্বল বোধ করলে ডাবের জল এবং স্যালাইন ওয়াটার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
আসলে উপবাসের সময় যে ধরনের খাবার খাওয়া হয়, তার খাদ্যশক্তি দিয়েই সারাটা দিন চলে। আর ইফতারের খাওয়াদাওয়ার উপর নির্ভর করে শরীর পুনরায় শক্তি ফিরে পায়। সুতরাং, রমজান মাসের এই দিনগুলোতে দুই সময়ের এই খাদ্যাভ্যাস খুবই প্রয়োজনীয়।