উত্তর দিনাজপুর জেলার ছোট্ট শহর কালিয়াগঞ্জ। শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে শান্ত স্নিগ্ধ নদী ‘শ্রীমতি‘। শোনা যায়, একসময় এই নদীর বুকে বড় বড় সব নৌকা চলত, তাতে দূরদূরান্ত থেকে মালপত্র আসা যাওয়া করত, রমরমা ছিল ব্যবসা বাণিজ্য। এখন সেই নদীর চেহারা পাল্টে গিয়েছে পুরোপুরি। জল গেছে শুকিয়ে, পলি আর শ্যাওলা পড়ে নদীর সৌন্দর্য আর আগের মতো নেই। এখন দেখলে মনে হয় এ এক জলাশয়, নদী নয়।
জানা যায়, ২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদীর মূল উৎস নাকি ওপার বাংলার ঠাকুরগাঁও-তে৷ ‘শ্রীমতি’ নামটা শুনলে অনেকেই বলেন, নদীরও এমন সুন্দর নাম হয়! আসলে, এই নদীর নামকরণের নেপথ্যে এক কাহিনী রয়েছে। শ্রীমতি যে নিছকই এক নদী তা নয়, সে এক কন্যাও বটে। এই নদীর পেছনে এক সুন্দরী নর্তকী আর এক রাজকুমারের গপ্পো আছে বলে শোনা যায়।
গল্পের রাজকুমারের নাম হারিয়ে গিয়েছে কালক্রমে। তাঁর আসল নাম যে কি ছিল তা কেউই সঠিক বলতে পারে না। কিন্তু, শ্রীমতি হারিয়ে যায়নি। সে কোন আমলের কথা! বাংলাদেশের কোনও এক গ্রামের নিবাসী ছিল এই শ্রীমতি নামের নর্তকী। বলা হত, তাঁর মতো সুন্দরী নাকি ওই দেশে আর কেউ ছিল না। তো, একসময় এই শ্রীমতিরই প্রেমে পড়লেন নায়ক রাজকুমার। শ্রীমতিও ফেরাননি রাজকুমারকে।
তাঁদের মধ্যে কথা হল, ভালোবাসার টানে নিয়মিত তাঁরা দেখা করবেন। সুখ দুঃখের নানা গল্প করবেন। তবে, বাধা হয়ে দাঁড়াল একটা জিনিস। দেখা করতে আসবার পথটি যে বেশ দুর্গম। রাজবাড়ি থেকে শ্রীমতির গ্রামে আসার জন্য কোনও পাকা রাস্তা ছিল না। অনেক উপায় ভেবে রাজকুমার স্থির করলেন শ্রীমতির গ্রামের পাশের বিরাট এক বিল থেকে মহানন্দা নদী পর্যন্ত একটি নদীপথ তৈরি করবেন তিনি। অতএব, যেই ভাবা সেই কাজ।
রাজকুমারের এই ভাবনা শুনে আশেপাশের মানুষও বেশ তারিফ করল। অবশেষে তৈরি হল সেই নদীপথ। একদিন সেই নদীপথে নৌকায় চেপে রাজকুমার হাজির হলেন শ্রীমতির গ্রামে। সন্ধ্যেবেলা শ্রীমতিকে সঙ্গে নিয়ে নদীর পাড়ে এক মহাকাল মন্দিরে এসে তাঁরা বিবাহ সম্পন্ন করলেন। গল্প এখানেই শেষ নয়। শ্রীমতি ছিলেন নীচু জাতের মেয়ে। রাজার বাড়ির ছেলে নীচু জাতের কন্যাকে বিবাহ করেছে শুনে চরম রেগে গেলেন রাজা।
রাগের মাথায় পেয়াদা পাঠিয়ে রাজকুমারকে নিয়ে এসে বন্দী করলেন কারাগারে। নিস্তার পেলেন না সদ্য বিবাহিত শ্রীমতিও। রাজা তাঁর লোক দিয়ে শ্রীমতিকে নৌকার সঙ্গে বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে মারলেন। শ্রীমতির এই নির্মম মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলেন রাজকুমার। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু বদলে গেলেও, শ্রীমতিকে হারানোর স্মৃতির নদী বয়ে চলেছে রাজকুমারের বুকে। একসময় রাজা হলেন তিনি।
এক কালে তাঁর প্রেয়সীর সঙ্গে দেখা করবার জন্য নিজে হাতে যে নদীপথ তৈরি করেছিলেন, তার নাম রাখলেন ‘শ্রীমতি’। বড় ভালোবেসে, আবেগতাড়িত হয়ে এই নাম দিয়েছিলেন তিনি। চারপাশের মানুষ অবাক হয়ে গেলেন রাজকুমারের এই কাণ্ড দেখে। কালক্রমে ওই জায়গাটির নাম হয়ে গেল ‘পতিরাজপুর’। এই নদীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রেমগাঁথা ছড়িয়ে পড়ল লোকের মুখে মুখে।
আজ সেই নদী তার ঢেউ হারিয়েছে, তার বুকের মাটিতে কৃষকরা সোনার ফসল ফলাচ্ছেন। কালিয়াগঞ্জের মানুষ শ্রীমতিকে আদর করে ডাকে ‘চিরামতী’। কালিয়াগঞ্জের বুকে শুধু যে শ্রীমতিই বয়ে চলেছে তা নয়, টাঙন, বালিয়া, কুমারী, গামারি, চাপাই এমন আরও নদীরা বয়ে চলেছে আপন বেগে।
শ্রীমতির গল্প বড়ই অদ্ভুত। বাংলাদেশের এক বিল থেকে তার যাত্রা শুরু, কালিয়াগঞ্জের মিত্রবাটির ভিতর দিয়ে সে বয়ে চলেছে দক্ষিণ পানে। আজ এই মিত্রবাটির শ্রীমতির ওপরে কাঁটাতারের বেড়া। এক কালে শ্রীমতির ভরা নদীতে ওপার বাংলায় ব্যবসা করতে যেতেন ধনকৈল আর গুদরিবাজারের বণিকরা। একসময় যে নদীর বুকে বড় বড় বজরা চলত, আজ সে এক মরা নদী। এই নদীর পাশেই রয়েছে শ্মশান।
কালিয়াগঞ্জের ভেলাই হাটের পাশ দিয়ে অনন্তপুর গ্রাম, মজলিশপুর হয়ে ধনকৈলের ওপর দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে সে। নদীর ওপর দিয়ে তৈরি হয়েছে ব্রিজ। একটি রয়েছে কালিয়াগঞ্জ শ্মশানের কাছে, আরেকটি রসিদপুর যাওয়ার পথে। আজও এই মরা নদীতে মাছ ধরতে আসেন জেলেরা। মাথায় ছাতা নিয়ে ঠাঁয় বসে থাকেন মাছের আশায়। ছোট মাছ পাওয়া গেলেও বড় মাছ মেলে কালেভদ্রে। আগে এই নদীতে জাল ফেললেই উঠত বড় বড় বোয়াল, কাতল। দেখা মিলত ইলিশেরও। তখন শ্রীমতি ছিল খরস্রোতা।
নদীর ঢেউ, কুলুকুলু শব্দ হারিয়ে গেলেও শান্ত শ্রীমতির আকাশে আজও যখন আষাঢ়ের মেঘ জমে, সেই দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়ে। শরতে শ্রীমতির পাড়ে মাথা দোলায় সাদা ধবধবে কাশবন। গ্রীষ্মের দাবদাহে নদী মরে যায়, জল শুকিয়ে যায় তার, তখন শ্রীমতি শ্রীহীন। অথচ এই শ্রীমতির পাড়েই এক কালে কত গল্প গড়ে উঠেছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে যাতায়াতের অন্যতম পথ ছিল যে নদী সে আজ একরাশ গ্লানি নিয়ে বয়ে চলেছে।
তবু, বেঁচে থাকুক নদীরা। পুরোনো স্রোত হারিয়ে গেলেও নিজের ছন্দেই বয়ে চলুক শ্রীমতি। যতদিন শ্রীমতি থাকবে ততদিন সে বাঁচিয়ে রাখবে কালিয়াগঞ্জকে। তার মরা গাঙে ঠিক একদিন বান আসবে।