পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন ইমরান খান। ৯ এপ্রিল অর্থাৎ গত শনিবার মধ্যরাতের ভোটে বিরোধীদের কাছে হেরে যান তিনি। জাতীয় পরিষদের মোট ৩৪২ জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য তাঁর প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোটদান করেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম বার ঘটল।
সূত্রের খবর, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী গত শনিবার সকালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসে। তবে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মধ্যরাতের পর। ইমরান খানের পদত্যাগের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাকে নিয়োগ করা হবে তা নিয়ে গত সোমবার ফের একটি অধিবেশনের আয়োজন করা হয়। পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা আছে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে।
অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে ইমরান খান জানিয়েছিলেন যে, বিরোধী সরকারকে তিনি স্বীকৃতি দেবেন না। তাঁর দাবি, আমেরিকার নেতৃত্বে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে নাকি তাঁর পদ থেকে সরানো হচ্ছে। এই কথার যদিও কোনও তথ্য বা প্রমাণ দিতে পারেননি ইমরান। ভোটের কিছু সময় আগে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার আসাদ কায়সারও পদত্যাগ করেছেন। ভোট পরিচালনা করার দায়িত্বে ছিলেন নওয়াজ শরীফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ, (PMLN)এর আইয়ায সাদিক।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের ২২ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন গত ২০১৮ সালের জুলাই মাসে হওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী পদে যোগ দেওয়ার আগে পাকিস্তানকে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইমরান খান। সেই সময় ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেন তিনি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। কিন্তু, বাস্তবে হল তার উল্টোটা। অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ার কারণেই ধীরে ধীরে বিপাকে পড়তে শুরু করে ইমরান খানের সরকার। মূলত, মুদ্রাস্ফীতির হার দ্রুত বেড়ে চলায় এবং বিদেশি ঋণের বোঝা তাঁকে সংকটে ফেলে দেয়।
শোনা যায়, এই অনাস্থা ভোটের কিছুকাল আগে থেকেই ইমরান খান বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন এবং বলেছিলেন এরা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে৷ আর, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে হাত রয়েছে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের। অন্যদিকে, ডেপুটি স্পিকার কাসেম সুরি রুল জারি করেছেন যে, পাকিস্তান সংবিধানের পঞ্চম অনুচ্ছেদ লংঘন করেছে এই অনাস্থা প্রস্তাব। এই অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র এবং সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের কথা উল্লেখ রয়েছে।
সূত্রের খবর, ইমরান খানের পুরোনো বিশেষ সহযোগী এবং পিটিআই নেতা ড. শাহবাজ গিল একটি ট্যুইট করে জানান, ইমরান খান প্রধানমন্ত্রিত্ব ত্যাগ করার আগে মুখ্য সচিব আজম খানের সংস্থাপন বিভাগে যোগদানের অনুরোধ করেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী এদিন আজমের পেশাদারিত্বের প্রশংসা করে বলেন, তিনি অত্যন্ত সততা এবং পরিশ্রমের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করছেন। আজমকে অনুরোধ অনুমোদনের পরেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যান ইমরান।
বর্তমানে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পরিবর্তে চেয়ারে বসতে চলেছেন মুসলিম লীগ নেতা শাহবাজ শরীফ। খুব শীঘ্রই নতুন সরকার ঘোষণা করবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের আসন্ন জোট সরকারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে শাহবাজের মন্ত্রীসভার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল পাকিস্তানের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে দাঁড় করানো এবং এটিকেই তার এজেন্ডার শীর্ষে রাখা। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর পরই পার্লামেন্টের বক্তৃতায় শাহবাজ ঘোষণা করেন, সরকারি কর্মচারীদের বেতন এবং পেনশন ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। এছাড়া, গম আটায় ভর্তুকি দেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, বর্তমানে পাকিস্তানের রাজনীতি প্রতিদিনই নতুন নতুন মোড় নিচ্ছে। এদিকে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ওপর রীতিমতো বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নওয়াজ শরীফের কন্যা মরিয়াম নওয়াজ। সূত্রের খবর, গত শুক্রবার পিএমএল-এনের নেত্রী মরিয়াম ইমরান খানের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং তাঁকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্যদিকে, পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রীর এই অনাস্থা ভোটে পরাজয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর অনাস্থা ভোটে পরাজয়ের তুলনা টেনেছেন বহু সমালোচকগণ। ইমরান খানকে নিশানা করে বলা হয়, এই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতা ত্যাগের জন্য এত কাঁদতে দেখা যাচ্ছে। অটল বিহারি বাজপেয়ীর সঙ্গে তুলনা টানার কারণ, অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন অটল বিহারি নিজেও৷ কিন্তু, সেই সময় তিনি তাঁর পদ থেকে নিজেই ইস্তফা দিয়েছিলেন। পরে অটল বিহারি বাজপেয়ী আবার সরকার গঠন করেন ক্ষমতায় ফিরে এসে। ১৯৯৬ সালে বাজপেয়ী দেশের ১১ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু, সেই সময় মাত্র একটি ভোটের জন্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয় তাঁর সরকার। এর কারণে, মাত্র ১৩ দিনের মধ্যেই ক্ষমতা হারাতে হয় অটল বিহারি বাজপেয়ীকে৷ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পূর্বে তিনি সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, “আপনি গোটা দেশ চালাতে চান, এ খুব ভালো কথা৷ আমাদের শুভকামনা আপনার সাথে সবসময় রয়েছে। আমরা দেশের সেবায় প্রতিনিয়ত কাজ করে যাব। সংখ্যার বলের সামনে আমরা নিজেদের মাথা নত করি। আপনি যে কাজ আপনার হাতে নিয়েছেন তা ততক্ষণ পর্যন্ত শেষ হবে না বলে আশ্বস্ত করছি আপনাকে। ততক্ষণ আরাম করে বসে থাকবেন না। মাননীয় স্পিকার স্যার, আমি আমার পদত্যাগ পত্র রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিতে যাচ্ছি।”
সূত্রের খবর, পাকিস্তানে অটল বিহারি বাজপেয়ীর এই খবরটি বেশ ছড়িয়ে পড়েছে৷ অনেকে সোশ্যাল মিডিয়াতেও এর বিভিন্ন ভিডিও শেয়ার করছেন। সমালোচকদের মতে, ইমরান খানের অনেক কিছু শেখা উচিত বাজপেয়ীর এই কথা থেকে৷ অনেকেই ইমরানকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ইমরান খান যদি ভারতকে তাঁর আদর্শ বলে মনে করেন, তাহলে তার শিক্ষা নেওয়া উচিত ভারতীয় রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে।