North 24 Parganas: দু ‘দেশের প্রশাসনের সিদ্ধান্তে দশমীতে টাকির প্রতিমা বিসর্জন হ’ল, একাদশীতে সাতক্ষীরার প্রতিমা নিরঞ্জন

আরও পড়ুন

অতিমারী এবং তারও আগে ২০১৮ সালের সাময়িক ঝামেলার পর দু’দেশের দুর্গা প্রতিমা নিরঞ্জন সাময়িক রদবদল ঘটেছে। অতিমারিই কাল হয়েছে এপার বাংলা ওপার বাংলা দুই বাংলার দুর্গা ঠাকুর নিরঞ্জনের। এতদিন পর্যন্ত বিজয়া দশমীর দিন দুই বাংলার দুর্গা প্রতিমা নিরঞ্জন হ’ত একসঙ্গে ইছামতি নদীর তীরে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হ’ত বহু লোক সমাগম। দুই বাংলার মানুষ এই একটা দিন বাধাহীনভাবে নৌকয় চেপে ইছামতির ওপর ঘুরে বেড়াতেন স্বাধীনভাবে। কিন্তু ২০১৮ সালে নিরঞ্জনের সময় যে বিপত্তি দেখা দিয়েছিল আর তারপরে কোভিড সমস্ত কিছু নিয়মকানুন বদলে দিয়েছে প্রতিমা নিরঞ্জনের ক্ষেত্রে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ২০১৮ সালে ওপার বাংলার মানুষ অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ নৌকয় চেপে এদেশে ঢুকে পড়েছিলেন। যা নিয়ে হয়েছিল অনেক বড় রকমের অশান্তি। রাত পর্যন্ত সেই অশান্তি চললেও আদপে অশান্তির যে কারন তাকে সুষ্ঠুভাবে মেটানো সম্ভব হয়নি। আর এর পরই ২০২০ সালে করোনার প্রকোপে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সবকিছুই। ২০২২ থেকে ফের নিরঞ্জনের পালা শুরু হলেও অতিমারীর প্রকোপ গ্রাস করেছিল অনেকটাই। আর এবছর অতীতের সব নিয়মকেই ভেঙে দিয়ে দুই প্রশাসন। এক জায়গায় বসে তারা সিদ্ধান্ত নেয় দুই বাংলার প্রতিমা নিরঞ্জন হবে দু’দিনে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এপার বাংলার প্রতিমা নিরঞ্জন সেদিনের মতোই আজও দশমীতেই সম্পন্ন হল টাকি শহর লাগোয়া ইছামতি নদীর উপর। আর ওপার বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিমা নিরঞ্জন হবে একাদশীর দিন। এত বছরের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে সকলেই যেনও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন হাহাকার করছেন আজ নিজেদের সংস্কৃতির মেলবন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার এই ঘটনাটিকে। টাকিতে ইছামতি নদীতে যখন একের পর এক প্রতিমা রঞ্জন চলছে তখন ইছামতি নদীর ওপারে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সেই নিরঞ্জনের দৃশ্যকে উপভোগ করছেন ওপার বাংলার মানুষ। আর মাঝখানে এই প্রথমবার রাজ্য পুলিশ এবং বিএসএফ দুই বাহিনীর কর্মকর্তারা সম্মিলিতভাবে দাঁড়িয়ে যায় ইছামতি নদীর মধ্যভাগে নৌকায় চেপে। অতন্দ্র প্রহরীর মত একাগ্র চিত্রে পাহারায় মগ্ন বিএসএফ থেকে রাজ্য পুলিশের কর্মীরা সকলেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই সকলেই এবছর হতাশ হয়েছেন ইছামতি নদীর উপর দুই বাংলার একসঙ্গে প্রতিমা নিরঞ্জন দেখতে না পেয়ে। তবুও যেনও কোথাও এপারে থেকেই মানুষ হয়তো আবারও বলে উঠছেন আসছে বছর আবার হবে।

 

পশ্চিমবঙ্গের টাকি হল ভারত ও বাংলাদেশকে পৃথককারী ইছামতি নদীর তীরে সবুজ ধান এবং সবুজ পুকুরের একটি শহর। টাকির রাস্তাগুলি পরী আলোর ছাউনিতে আলোকিত হয়, লাউডস্পিকার থেকে বাংলা গান এবং বলিউডের হিন্দি চটুল গান চলে। প্যান্ডেল, দেবী দুর্গার সবচেয়ে লম্বা, চকচকে প্রতিমা কোনটি, প্রতিমাগুলি করা বহন করছে এসবের প্রতিযোগিতা চলে।

 

 

তবে টাকিকে অন্যান্য সীমান্ত শহর থেকে আলাদা করে তা হল পুজোর শেষ দিনে একটি বিশেষ ঐতিহ্য। এই অঞ্চলের বাসিন্দারা যেমন মূর্তি বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সীমান্তের ওপারের জেলা সাতক্ষীরাতেও এর প্রতিপক্ষরা তা করে থাকেন। উভয় শহরের বাসিন্দারা তাদের নিজ নিজ নৌকায় প্রতিমা স্থাপন করে এবং আন্তর্জাতিক সীমানা বরাবর নদীর মাঝখানে ভাসমান সীমান্ত নিরাপত্তা নৌকায় যাত্রা করে। তাদের মধ্যে এক ডজন মিটারের মধ্যে, প্রতিবেশীদের দুটি দল একে অপরের দিকে হাত নেড়ে, শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবং — ”আসছে বছর আবার হবে” এমন স্লোগান দেন। একসঙ্গে প্রতিমা বিসর্জন করুন। একটি দিনের জন্য, ভূ-রাজনীতি দ্বারা বিভক্ত দুই দেশের নাগরিকরা একটি যৌথ ঐতিহ্য উদযাপন করতে একত্রিত হন।

 

যৌথ উদযাপনের অভ্যাস কয়েক দশক আগের। নদীর সীমানা এবং প্রতিবেশী দেশে কেনাকাটা এবং বিসর্জনের প্রাক্কালে সামাজিকীকরণ – বিসর্জনের দিন এসব চলে নিয়ম করেই। দু’দিকে একটি করে মেলা হয়। ওপারের সাতক্ষীরার মেলা থেকে নারকেল এবং আখ কেনেন। তারা এখান থেকে তেল, সাবান-সহ নানান উপকরণ কিনে নিয়ে যান। কিছু মানুষ এমনকি তাদের ছেলে বা মেয়ের জন্য বিবাহের মিল খুঁজে পান। হিন্দু বা মুসলমান, তারা সবসময় আমাদের সঙ্গে সর্বোত্তম আতিথেয়তার মতন আচরণ করেন। এদিন একটি অলিখিত চড়ুইভাতিও হয়। বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতে আসা মানুষ এদিন সকালে এসে বিকেলে ডাক্তার দেখিয়ে ফেরেন কেউ কেউ। উপলব্ধ চিকিৎসা সুবিধা ব্যবহার করলেও, ভারতীয় দর্শকরা বাংলাদেশের সস্তা, “কিং সাইজ” সিগারেটের প্রতি আসক্ত। এদিন অনেকেই জিনিসপত্র কেনাবেচা করেন না, শুধু বিনিময় করে থাকনে।

সন্ধ্যা ৬টায় সীমান্তরক্ষীরা বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করে থাকেন। বাসিন্দারা নিজ নিজ নৌকা ও ট্রলারে উঠে নদী পার হয়ে নিজ দেশে ফিরে যান। দর্শনার্থীদের জন্য কোনও পাসপোর্ট-চেক বা এন্ট্রি পাস নেই। টাকির বাসিন্দাদের মতে, এর হৃদয়ে একটি অন্তর্নিহিত বিশ্বাস রয়েছে। আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ, অবৈধ অভিবাসন এবং গবাদি পশুর ব্যবসা এসব এদিনের জন্য অচল। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদরা তাদের ভাগ করা জাতিগত পরিচয়, নরম কূটনীতির পারস্পরিক অনুশীলন এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের দুর্গাপুজোর গুরুত্বের কারনে সীমান্ত শহরগুলির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে করেন।

আমেরিকায় পাঠরত পোস্ট ডক্টরেট করতে যাওয়া অর্জক ভট্টাচার্য বলেন- “পুজোর উৎসব সবসময়ই ধর্মীয় বিষয়ের চেয়ে বেশি সামাজিক। “শুধু মুসলমানরা এই উদযাপনে বিপুল সংখ্যক অংশগ্রহণ করে না, বেশিরভাগ প্যান্ডেল নির্মাতা সম্প্রদায়ের মানুষও এই উৎসবের অন্তর্ভুক্ত।” সীমান্তবর্তী অনেক গ্রাম একে অপরের চিৎকারের দূরত্বের মধ্যে রয়েছেন, কখনও কখনও একটি সরু কাদা পথ বা অগভীর স্রোতে বিচ্ছিন্ন মানুষেরাও এদিন ছুটে আসেন। তাদের ভাগ করা ভাষাগত পরিচয়ের প্রেক্ষিতে, ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত-শহরে বসবাসকারী অনেক বাসিন্দার পক্ষে চুক্তি করা সহজ ছিল না। অনেকেরই সীমান্তের ওপারে বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজন ছিল – ইতস্তত এবং বিক্ষিপ্ত অবস্থায় তাদের বাড়ির উঠোনে—এবং অবাধ চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞাগুলি প্রায়ই সহ্য করত না দু’দেশের আইন।

শ্রী ভট্টাচার্যের মতে, রায় চৌধুরী, একটি প্রভাবশালী জমিদার পরিবার, প্রথম ১৯৭০ সালে টাকিতে সাম্প্রদায়িক দুর্গাপূজা উদযাপন শুরু করে। এটি আকারে বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তের ওপার থেকে দর্শনার্থীরা বিসর্জনের জন্য আসেন।

১৯৮৯ সালের শুরুতে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৪ হাজার ০৯৮ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ ধরনের কনসার্টিনা বা ব্লেড বিশিষ্ট তারের সঙ্গে একটি ১০ ফুটের বেড়া এবং সীমানা-স্তম্ভের জন্য দু’ফুটের পাথরের খুঁটিগুলি সীমান্ত বরাবর দৃশ্যমান। ভারত সরকার ইছামতি নদীর গা ঘেঁষে বেড়া দেয়নি, যেহেতু স্থানীয় জীবিকা এটির উপর নির্ভরশীল, তবে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়িয়েছে। তারা নদীর ধারে ওয়াচ টাওয়ার এবং নদীতে ভাসমান ফাঁড়িও স্থাপন করেছে।

২০১১ সালের মে মাসে, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে। দলটি, বাংলাদেশের সঙ্গে আরও ভালো সম্পর্কের প্রচারের জন্য পরিচিত জানা গেছে, টাকিতে একটি মিলন মেলা বসে।

টাকিতে, ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী সতর্ক থাকে প্রশাসন। পাতাবাহার নদীপথে অনন্য পুজো উদযাপনের সাক্ষী হতে হাজার হাজার মানুষ এসেছিলেন। ইছামতি প্রমোনেডের দৈর্ঘ্য বরাবর প্রায় শতাধিক নৌযান রয়েছে। সন্ধ্যা ৬টায় নিরাপত্তা বাহিনী ঘোষণা করে যে উদযাপন বন্ধ করা উচিত। পরের ঘন্টায়, তাদের লাউডস্পিকার এবং ফ্ল্যাশলাইটগুলি নৌকাগুলিকে উপকূলে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

তবে এবছর একাদশীর দিনে বাংলাদেশের সাতক্ষীরার মানুষেরা প্রতিমা নিরঞ্জন করবেন বলেই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর ফলে দুপার বাংলার মানুষই মনমরা হয়ে টাকিতে প্রতিমা বিসর্জন দেখেছেন। তথাপি সকলেরই প্রার্থনা- ফের যেনও ওই একটা দিন দুপার বাংলার মানুষ সম্মিলিতভাবে প্রতিমা নিরঞ্জন করতে পারেন। তা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।

উত্তর ২৪ পরগণার টাকি থেকে নিজস্ব প্রতিনিধির রিপোর্ট, টাইমস ফোর্টিন বাংলা।

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close