খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার ঐতিহ্য, সাবেকিয়ানা, জমিদারিত্বের প্রমাণ ইটাচুনা রাজবাড়ী

আরও পড়ুন

বাঙালি বরাবরই ভ্রমণপিয়াসী, বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। টুকটাক ছুটিছাটা, ফাঁকফোকর পেলেই বাক্সপ্যাটরা বেঁধে দে ছুট। তবে, এখন কাজের চাপ এবং সময়ের অভাবে তা কমে গিয়েছে অনেকটাই। বিগত দু বছরে করোনার জেরে মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন ঘটেছিল। অনেকেই এখন সময়ের অভাবে লম্বা ছুটি নিয়ে বেড়াতে যেতে পারেন না। কিন্তু, তা বলে কি আর ভ্রমণ পিপাসাকে আটকে রাখা যায়! দু-একদিনের জন্য তো দিব্যি কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসাই যায়। তেমন সফরের জন্য একেবারে যথাযথ হল খন্যানের ইটাচুনা রাজবাড়ী। গত কয়েক বছর ধরে এটি বেশ জনপ্রিয় ভ্রমণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে বাঙালির কাছে।

ইটাচুনা রাজবাড়ী

গাড়ি নিয়ে হোক কিংবা ট্রেনেই হোক, চটজলদি উইকেন্ড ভ্রমণের জন্য এই ইটাচুনা রাজবাড়ী একেবারে যথাযথ। একদম অন্য স্বাদের ভ্রমণ হবে এটি। কলকাতা থেকে প্রায় ৬৬ কিলোমিটার দূরে হুগলির  খন্যান স্টেশন থেকে টোটো ধরেই পৌঁছে যাওয়া যায় গন্তব্যে। ইতিহাস বলে, এই রাজবাড়ী প্রায় আড়াইশো বছরের পুরোনো। এর পূর্বপুরুষরা অষ্টাদশ শতাব্দীতে মারাঠা থেকে এসেছিলেন মারাঠা আক্রমণকারী বা বর্গী হিসেবে। সেইসময় তাঁদের পদবি ছিল কুন্দন। কিন্তু, পরে মারাঠা বর্গীরা বাংলাকেই তাদের স্থায়ী নিবাস হিসেবে বেছে নেন। এখানকার ভাষা, সংস্কৃতি, আচার আচরণের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে তোলেন ধীরে ধীরে। তখন নিজেদের কুন্দন পদবিকে পরিবর্তন করে তাঁরা কুণ্ডু করে নেন।

ঠাকুরদালান

তাঁদের জমিদারি স্থাপিত হয় সেখানে, সেই সূত্রেই ১৭৬৬ সালে গড়ে ওঠে এই বিখ্যাত ইটাচুনা রাজবাড়ী। তৎকালীন বর্গী উত্তরসূরী সাফল্য নারায়ণ কুণ্ডু এই বাড়িটি স্থাপন করেন। বর্তমানে সেই বিশাল রাজবাড়ীর একাংশ হোম স্টে হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে বেড়াতে আসা অতিথিরা সেই পুরোনো আমলের রাজকীয় কায়দায় থাকার সুযোগ পান। অসংখ্য ঘর রয়েছে এই রাজবাড়ীতে, যার আবার অভিনব সব নামকরণ রয়েছে। পরিবারের সদস্যদের নামে যেমন- ঠাকুমা, গিন্নি মা, বড়ো বৌদি, ছোট বৌদি, বড়ো মা, মেজো মা এমন সমস্ত নাম রয়েছে ঘরগুলির। 

টানা বারান্দা

বর্তমানে আধুনিক সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি বিভিন্ন ঘরে রয়েছে সমস্ত প্রাচীন আসবাব। যাতে সেই রাজকীয় আমেজটি উপলব্ধি করা যায়। রাজবাড়ীটি গ্রামের মধ্যে অবস্থিত বলে, অতিথিদের থাকবার  জন্য রাজবাড়ীর আমবাগানে বেশ কিছু মাটির বাড়িও তৈরি করা রয়েছে। প্রায় ২০ বিঘা এলাকা জুড়ে এই রাজবাড়ীটি তৈরি করা হয়েছিল। তার মধ্যে রয়েছে- কাছারি মহল, অন্দরমহল, ঠাকুর দালান, আমবাগান, নাচঘর, খিড়কিমহল, খামার বাড়ি ইত্যাদি। রাজবাড়ীর অপূর্ব সুন্দর ঠাকুরদালানে প্রায় আড়াইশো বছর ধরে চলে আসা ভগবান শ্রীধর জীউয়ের পুজো হয় দিনে তিনবার করে।  

খাবার ঘর
রাজসিক খাদ্য

পুরোনো দিনের সমস্ত সৌন্দর্য, আভিজাত্যকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখে এ যুগের মানুষের কাছে তা মেলে ধরার এ এক অসাধারণ প্রয়াস। মূল ফটক দিয়ে বাড়ীর চত্বরে ঢুকলেই দেখা যাবে ইংরেজির ‘U’ অক্ষরের আদলে তৈরি এই রাজবাড়ী। দোতলায় রয়েছে টানা বারান্দা। ডানদিকের মহলে একতলার বারান্দা দিয়ে ঢুকলে দেখা যায় একটি বিরাট হলঘর। তাতে দুটি বিরাট বিছানা, পুরোনো আমলের ইজি চেয়ার, বিশালাকার সেক্রেটারিয়েট টেবিল, সোফা, অনেকগুলি চেয়ার, মাথার ওপর একখানা বিশাল নকশা করা ঝাড়বাতি, আর রয়েছে পেছন দিকের সিলিং থেকে টাঙানো পুরোনো দিনের দুটি টানা পাখা।

দোতলার বারান্দা

জানা যায়, অতীতে এই হলঘরই ছিল মূল কাছারি অফিস। এর পাশেই রয়েছে একটি বিরাট খাবার ঘর। আর, অন্যদিকের আরেকটি ঘরে রয়েছে কিছু হাতে আঁকা ছবির প্রদর্শনী এবং বিক্রির ব্যবস্থা। দোতলার বারান্দাগুলিও বেশ সুচারুভাবে সজ্জিত। পুরোনো দিনের সব আসবাব, দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে সেই আমলের ছবি, একটি দেওয়ালে রয়েছে কার্পেট টাঙানো। একতলার মতো দোতলাতেও রয়েছে এক বিরাট হলঘর। সেই ঘরে আছে পাথরের সেন্টার টেবিল, রাজপুরুষকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার তাঞ্জাম, আগেকার দিনের টেলিফোন, হুঁকো স্ট্যান্ড ইত্যাদি। 

পুরোনো দিনের আসবাব এবং ছবি টাঙানো রয়েছে বারান্দার দেওয়ালে

রাজবাড়ীর তিনতলার ওপরে রয়েছে বিশাল ছাদ। ওপর থেকে দেখতে ভারী চমৎকার লাগে রাজবাড়ীটি। তবে, এখানে একটা কথা, শুধু দিনের বেলাতেই যারা ভ্রমণ করতে যাবেন রাজবাড়ীতে, তাদের কিন্তু অন্দরমহলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। সেইজন্যেই তিনতলার ছাদ থেকে দেখে নিতে হয় রাজবাড়ীর এই অংশের সৌন্দর্যটুকু। দিনের বেলাতে রাজবাড়ীর যা রূপ, সন্ধ্যে হলেই তা পুরো পালটে যায়। সমস্ত বারান্দা জুড়ে যখন আলো জ্বালানো হয়, ঠাকুরদালান ঝলমলিয়ে ওঠে লোহার কারুকাজ করা স্ট্যান্ডের আলোয়, তখন ইটাচুনা হয়ে ওঠে মায়াবী, মোহময়। 

রাতের আলো ঝলমলে ইটাচুনা

উল্লেখ্য, বলিউডের ‘লুটেরা’ সিনেমার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। সেই বিখ্যাত সিনেমার শ্যুটিং হয় এই ইটাচুনা রাজবাড়ীতে। বাংলার গর্বের মুকুটের এক পালক এই ঐতিহ্যপূর্ণ রাজবাড়ী। সামনের এক উইকেন্ডে বেরিয়ে পড়ুন এই রাজকীয় স্বাদ উপভোগ করতে। আশা করা যায়, মন্দ লাগবে না। 

লুটেরা ছবিতে সোনাক্ষী সিনহা

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close