Malda: চৈতন্যদেবের আগমনের কারনেই গুরুত্ব বেড়েছে রামকেলি মেলার

আরও পড়ুন

কিংবদন্তিতে আছে ১৫১৫ সালের জুন মাসে শ্রীচৈতন্য গৌড়ের রামকেলি গ্রামে আসেন। রামকেলি গ্রামে শ্রীচৈতন্যের সেই পদার্পণের স্মরণে ফি-বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তিতে এক মহামেলার আয়োজন করা হয়। যা রামকেলির মেলা নামে পরিচিত। এটাই মালদা জেলার সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন মেলা। বর্তমানে একই সঙ্গে শ্রীশ্রী মদনমোহন জিউ-র বার্ষিক উৎসবও পালিত হয়। পঞ্চরত্ন মন্দিরে মহা সমারোহে মদনমোহন ও রাধারানির পুজো হয়। আর এবছর আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত বা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস সংক্ষেপে ইসকন মন্দিরে প্রথম গৌর নিতাই-এর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। মদনমোহন মন্দির ছাড়াও বেশ কিছু স্থায়ী ও অস্থায়ী আখড়া ঘিরে জমে ওঠে পনেরো দিনের মেলা। সেখানে পূজোর্চনার পাশাপাশি ২৪ প্রহরব্যাপী কীর্তনের আসর বসে ।কোথাও বা বাউল। এই কীর্তন যেমন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাধন ভজনের মাধ্যম, ঠিক তেমনি পদাবলি সাহিত্য ও কীর্তন বঙ্গ সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যশালী উপাদান। শহরে আজ ব্রাত্য হলেও গ্রামবাংলার সংস্কৃতিতে যাত্রাপালার সঙ্গে আজও টিকে আছে কীর্তনের অনুষ্ঠান। আর কীর্তন হল রামকেলি মেলা উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ।

মালদা শহর থেকে দূরত্ব মাত্র দশ কিলোমিটার হলেও এই মেলা সম্পূর্ণ গ্রামীণ মেলা। গ্রামের মানুষদের চাহিদা মেটাতে তাদের পছন্দসই সম্ভার নিয়ে ব্যবসায়ীরা হাজির হন ব্যারাকপুর, বহরমপুর, কলকাতা থেকে। একাধারে থাকে ভেড়ার লোমের আসন আর পশমের ছোট বাজার পশমশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের। মেলে শীতলপাটির খোঁজও। যেহেতু মালদা জেলার গ্রীষ্মের মেলা, তাই রকমারী আম এই মেলার মূল আকর্ষণ। দুই দিনাজপুর ও মুর্শিদাবাদ ছাড়াও ভক্ত দর্শনার্থীরা আসেন জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, বীরভূম, নদিয়া জেলা থেকেও। আসেন কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের মানুষও। অবাঙালি অসংখ্য দর্শনার্থী থাকেন এই মেলায়। জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তির আগেই বর্ষা এসে যাওয়ায় বৃষ্টি ও কাদা এই মেলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবু প্রতি বছর লাখো মানুষের ভিড়ে জমে ওঠে মেলায়।

রামকেলি মেলা প্রাঙ্গনেই রয়েছে গয়েশ্বরী মন্দির। দেশের এখানেই একমাত্র মাতৃ-পিন্ডদানের ব্যবস্থা রয়েছে।

লোকোমুখে প্রচলিত আছে- “গৌড়ের নিকটে গঙ্গাতীরে এক গ্রাম
ব্রাক্ষ্মন সমাজ তার রামকেলি নাম “

রামকেলি ঐতিহাসিক দিক থেকে এটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ একটি গ্রাম। বৃন্দাবন দাস রচিত চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে গ্রন্থে এই গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রামনাম প্রসঙ্গে এই গ্রামের নামের উৎসটি জানা যাক। এই গ্রামের নাম রামকেলি হল কি করে? এই গ্রামের নাম প্রসঙ্গে একটি জনশ্রুতি শোনা যায় যে, বনবাসে রামচন্দ্র থাকাকালীন তাঁর শ্বশুরবাড়ি মিথিলা যাওয়ার পথে পুন্ড্রদেশের মালদায় কিছুদিন কাটিয়ে যান। এখানে হনুমান রাম, সীতা ও লক্ষ্মনকে আম খাওয়াতে কালিন্দী নদীর তীরে এই গয়েশ্বরীর মন্দির চত্বরের বিশাল আমবাগানে তাদের নিয়ে আসেন। এখানে এসে আমের স্বাদে ও গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন ভগবান রামচন্দ্র আম নিয়ে “কেলি” অর্থাৎ খেলা শুরু করেছিলেন। তাই এই জায়গার নাম হয়েছে রামকেলি।

পূর্ব পুরুষের পিণ্ডদান মানেই গয়া। এই বিষয়টি সকলেরই জানা। কিন্তু অনেকেরই হয়তো বিষয়টি অজানা- দেশের মধ্যে এই বাংলাতেই রয়েছে মহিলার পিণ্ডদানের একমাত্র ব্যবস্থা। যা সারা দেশের এই একটিমাত্র স্থান, যেখানে মহিলাদের দ্বারা পিন্ডদান ব্যাবস্থার প্রথা চালু রয়েছে। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়ের গয়েশ্বরী মন্দিরে রয়েছে সেই ব্যবস্থা । মাতৃগয়ায় মায়ের নামে পিণ্ড দেন মেয়েরা। লোকমুখে আছে, এখানেই নাকি মায়ের পিণ্ডদান করেছিলেন দেবী সীতাও। শ্রীচৈতন্যদেবের আগমণ উপলক্ষে পাঁচশো বছরের বেশি সময় যাবৎ জৈষ্ঠ্য সংক্রান্তিতে বসে রামকেলি মেলা । সেখানে তিনদিন ধরে চলে মাতৃ পিণ্ডদান পর্ব।

মালদার গৌড়ে অবস্থান প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব তীর্থ রামকেলি গ্রামের। প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি তিথিতে চৈতন্যদেবের আগমনকে স্মরণ করে চার দিন ব্যাপী রামকেলি উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয় এখানে। এই রামকেলি মেলার অন্যতম আকর্ষণ হল মাতৃ পিণ্ডদান। রামকেলি গ্রামের নিকটে গৌড়ের প্রসিদ্ধ ফিরোজ5 মিনার অবস্থান করছে। এই ফিরোজ মিনারের পশ্চিম দিকে আম বাগানের মধ্যে আছে গয়েশ্বরী মন্দির। কেউ কেউ আবার একে গৌড়েশ্বরী মন্দির বলে অভিহিত করে থাকেন। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী এই জায়গাটিকে আগে বলা হত বামন পাড়া। যদিও কথিত আছে- আসল মন্দির নবাবী আমলে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, মূল মন্দির গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মন্দিরে পাথরে খোদাই করা একটি চতুর্ভুজ দেবী মূর্তি আছে যাকে গয়েশ্বরী বা গৌড়েশ্বরী বলে অভিহিত করা হয়। আর এই মন্দিরে হয় মাতৃ পিণ্ডদান।

বলা বাহুল্য ভারতবর্ষের আর কোথাও এই মাতৃ পিণ্ডদান হয় না।
এখানে মূলত: মহিলারাই মায়ের পিণ্ডদান করে থাকেন। কোনও পুরুষ পিণ্ডদান করেন না। যারা পিণ্ডদান করেন তারা মূলত: অবাঙালি নিম্নবর্গীয় সমাজের মানুষজন। এদের অধিকাংশই বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসেন। এই পিণ্ডদানের পুরোহিতরা প্রধানত বিহারি সমাজের পুরোহিত। পিণ্ডদান করার পর সেই পিণ্ডটি নতুন বস্ত্রখণ্ডে মুড়ে পার্শ্ববর্তী পুকুরের জলে ফেলে দেওয়া হয়। এরপরে পিণ্ডদানকারী মহিলা মন্দিরের ছাদে গিয়ে ঘিয়ের প্রদীপ প্রজ্বলন করেন পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশে। মন্দির চত্বরে তৈরি করা নকল নদী অর্থাৎ বৈতরণী পার হন পিণ্ডদানকারী মহিলারা। এরপরে তারা গৌড়েশ্বরী বা গয়েশ্বরী মন্দিরে পুজো দিয়ে দুপুরে মন্দিরের অন্নভোগ গ্রহণ করেন।

এই পিণ্ডদান কেবল রামকেলি মেলার সময়ই হয়, অন্য সময় হয় না। মূলত: ভোর পাঁচটা থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত পিণ্ডদান চলে। তিনি জানান, ধীরে ধীরে এই মন্দিরে পিণ্ডদানকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসঙ্গে মন্দিরের জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ যেমন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বর্তমান যুগের সঙ্গে সমাজ পরিবর্তন করছেন, পাশাপাশি মানসিক দিক থেকে এখনও সেই প্রাচীন পদ্ধতিকে নিজেদের বিশ্বাস ও ভক্তির মাধ্যমে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছেন সকলেই। গয়েশ্বরী মন্দিরে মাতৃ পিণ্ডদান তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

এবার আসা যাক রামকেলি গ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গে। ইতিহাস বলছে- ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে হোসেন শাহ তখন গৌড়ের সুলতান। ১৫১৪ কি ১৫ অব্দে শ্রীচৈতন্য দেবের আগমন ঘটে এই রামকেলি গ্রামে। ভক্তি ধর্ম প্রচারে দাক্ষিণাত্য, ওড়িশা থেকে মথুরা, বৃন্দাবন যাওয়ার পথে এই গ্রামে পদার্পণ করেন। রামকেলিতে শ্রীচৈতন্যদেবকে দেখতে আসার জন্য হাজার হাজার মানুষের ভীড় উপচে পড়ে। এই জমায়েত দেখে হোসেন শাহ বেশ অবাক হন। এই সময় হোসেন শাহ র দুই বিশস্ত রাজকর্মচারী অমর ও সন্তোষ কৃষ্ণ মন্ত্রে চৈতন্য দেবের কাছে দীক্ষা নেন। বস্তুত দীক্ষা গ্রহণ করার পরই তাদের নাম হয় সনাতন গোস্বামী ও রূপ গোস্বামী।

রামকেলির প্রসিদ্ধ মেলা শ্রীচৈতন্যদেবের আগমন উপলক্ষে প্রতি বছর জৈষ্ঠ সংক্রান্তির দিনে বিরাট আয়োজনের মাধ্যমে হয়ে আসছে। ১৫১৫ সালে সনাতন গোস্বামী ও রূপ গোস্বামী এই মেলার সূত্রপাত ঘটান। পাঁচশ বছরের অধিক বয়সী এই মেলার মাঝে প্রায় দেড়শো বছরের অধিক সময় বন্ধ ছিল। পরে আবার তা চালু হয়। আগে মেলা প্রায় ত্রিশ দিন যাবৎ চলত। এখন এই মেলার স্থায়িত্ব মাত্র ১০ দিনে নেমে এসেছে। মূল মেলাটি চলবে ১৮ জুন, রবিবার পর্যন্ত। বৈষ্ণবসমাজে রামকেলির মেলা ‘ গুপ্ত বৃন্দাবনের মেলা’ হিসেবেও পরিচিত।

আপাতত চারদিনব্যাপী মূল রামকেলি মেলার পরিসমাপ্তি ঘটছে ১৮ জুন রবিবার। সেইদিন দর্শনার্থীর সংখ্যা যে বাড়বে তা বলাই বাহুল্য।

মালদার রামকেলি মেলা ঘুরে চন্দন ঘোষের রিপোর্ট, টাইমস ফোর্টিন বাংলা।

তথ্য সহযোগিতায় -মালদহের দেবদেউল; ড. নিমাই চন্দ্র ঝা, আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ, আজকাল খবরের কাগজ-সহ মালদা জেলা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। পাশাপাশি তথ্য চয়ন সায়নদাস মুখোপাধ্যায় ও অর্ঘ দাসের লেখনী থেকে সংগৃহীত। সর্বোপরি চিত্র সহযোগিতায় গুগল।

- Advertisement -

সম্পর্কিত খবর

- Advertisement -

ট্রেন্ডিং

close