পাঁচ বছর পরেও রাজকুমার রায়ের রহস্যজনক মৃত্যুর কিনারা করতে পারেনি সি আই ডি। স্বামীর ছবি বুকে নিয়ে কাঁদছেন প্রয়াত রাজকুমার রায়ের স্ত্রী অর্পিতা বর্মন রায়। আসছে পঞ্চায়েত ভোট। অর্পিতাদেবী মনে করেন, ভোট মানেই মৃত্যু। আবার কেউ স্বামী হারাবে, কেউ হবেন সন্তানহারা। তাই ভোটের নামে প্রহসন বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন অর্পিতাদেবী।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ১৩মে পঞ্চায়েত ভোট ছিল। আর পাঁচজন শিক্ষকদের মত ভোটকর্মী হিসেবে ডাক পড়েছিল উত্তর দিনাজপুর জেলার করণদিঘি ব্লকের দোমহনা হাইমাদ্রাসা স্কুলের সহ শিক্ষক রাজকুমার রায়ের। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্বকে মাথায় তুলে নিয়ে তিনি জেলা নির্বাচন দফতরে হাজির হয়েছিলেন। তাকে ইটাহার ব্লকের সোনাপুর এফ পি স্কুলের প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি নির্বাচনের সমস্ত কাগজপত্র বুঝে নিয়ে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে হাজির হয়েছিলেন। সকাল থেকে ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ পর্ব শুরুও হয়েছিল। বেলা বাড়তেই শাসক দলের নেতারা ভোটকে প্রহসনে পরিণত করতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ। রাজকুমারবাবু তার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বলে অভিযোগ। কিছু সময় বাদে রাজকুমার রায় আচমকাই ভোটগ্রহণ কেন্দ্র থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। রাজকুমারবাবু নিখোঁজ হওয়ায় তার পরিবর্তে অন্য একজনকে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে ভোট পর্ব সম্পন্ন করা হয়েছিল। বাকিটা ইতিহাস। ১৫ মে তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ রেল লাইনের ধার থেকে উদ্ধার হয়েছে। আগামীকাল রাজকুমার রায়ের মৃত্যু দিনকে ভোটদাতা – ভোটকর্মী সংহতি দিবস হিসেবে পালন করবে রাজকুমার রায় হত্যার বিচার চাই মঞ্চ।
একজন প্রিসাইডিং অফিসার নিখোঁজ হওয়ার পর তাকে উদ্ধারে নির্বাচন দফতর তথা জেলা পুলিশ প্রশাসনের যে ধরনের তৎপরতা থাকা উচিত ছিল প্রশাসনের সেই তৎপরতা চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ। নিখোঁজ রাজকুমার রায়কে অবিলম্বে উদ্ধারের দাবিতে আন্দোলনে নামেন নির্বাচন কর্মীরা। রায়গঞ্জ ঘড়ি মোড়ে রাস্তা অবরোধ করলে সেখানে তৎকালীন মহকুমা শাসক হাজির হয়েছিলেন। নির্বাচন কর্মীদের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছিল মহকুমা শাসকের উপর। মহকুমা শাসককে শারীরিকভাবে হেনস্থার ঘটনায় রায়গঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। পুলিশ এস সি এস টি অ্যাক্রসিটি ধারায় মামলা ঋজু করেছিল। গ্রেফতার হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক। ভোটের একদিন পর রায়গঞ্জ শহর থেকে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে সোনাডাঙ্গি এলাকার রেল লাইনের ধার থেকে রাজকুমার রায়ের ক্ষত বিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়েছিল। এই ঘটনার পর এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে ওঠে। নির্বাচনকর্মী রাজকুমার রায়ের রহস্যজনক মৃত্যুতে সি আই ডি তদন্তভার নিয়েছিল।তৈরি হয়েছিল ‘রাজকুমার রায় হত্যার বিচার চাই মঞ্চ’ নামের একটি সংগঠন। রাজ্যজুড়ে নির্বাচনকর্মী এবং সরকারি কর্মীদের আন্দোলনকে প্রশমিত করতে ২০১৮ সালে ১৬ জুলাই রাজ্য সরকার প্রয়াত রাজকুমার রায়ের স্ত্রী অর্পিতা বর্মন রায়কে উত্তর দিনাজপুর জেলা শাসকের দফতরে চাকরি দেয়। সরকার চাকরি দিয়ে আন্দোলনকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু ‘রাজকুমার রায় হত্যার বিচার চাই মঞ্চ ‘আন্দোলন থেকে পিছু হটেনি। লাগাতার আন্দোলন এবং আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘটনার ৩ বছর নির্বাচন কর্মীর ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০ লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছে। ঘটনার পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলেও আজও রাজকুমার রায়ের রহস্য-মৃত্যুর কিনারা হয়নি। পাঁচ বছর স্বামীর মৃত্যু রহস্য অধরা থেকে যাওয়ায় স্বামীর ছবি বুকে আকড়ে কাঁদছেন অর্পিতাদেবী ও তার সন্তানরা। সি আই ডি তদন্তে ভরসা হারিয়েছে ‘রাজকুমার রায় হত্যার বিচার চাই মঞ্চ’। পঞ্চায়েত ভোটে ভোটকর্মীদের সুরক্ষার নিশ্চয়তার দাবিতে ফের সরব হয়েছেন বিচার চাই মঞ্চের সদস্যরা।
পঞ্চায়েত ভোট দোরগোড়ায়। উপযুক্ত নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়াই এই ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভোটকে কেন্দ্র করে কত মানুষের প্রাণ যাবে। ভোটের কথা শুনতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন অর্পিতাদেবী। কারন, তার মত আবার কত স্ত্রী তার স্বামীকে হারাতে পারেন। কত মা তার সন্তানকে হারাবেন। তাই এই ভোটের নামে প্রহসনকে তিনি আর দেখতে চান না। স্বামীর মৃত্যুর পর সরকার তাকে চাকরি দিয়েছেন। মৃত্যুর ক্ষতিপূরন বাবদ দশ লক্ষ টাকা পেয়েছেন। পাননি শুধু স্বামীকে। সন্তানরা পায় নি তার বাবাকে। রহস্যজনক মৃত্যুর সঠিক কারন জানতে অর্পিতাদেবী এবং প্রয়াত রাজকুমারবাবুর মা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। আদালত কবে এই মামলার নিস্পত্তি করে মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটন করবে সেদিকেই তাকিয়ে আছে তার পরিবার-সহ রাজ্যের মানুষ। এই সময়ে রাজ্যের একাধিক মামলার তদন্তভার সি বি আই,এন আই এ এবং এস আই টি-এর হাতে গেলে উপেক্ষিত থেকে গেছে রাজকুমার হত্যা মামলাটি। নিহত রাজকুমার রায়ের মা আদালতের দ্বারস্থ হয়েও কোন নির্দেশ না মেলায় হতাশ নিহতের পরিবার।
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ থেকে উত্তম পালের রিপোর্ট, টাইমস ফোর্টিন বাংলা।