জেলার অতি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প ও লোকশিল্পের প্রচার এবং প্রসারের লক্ষ্যে হিস্টরিক্যাল সোসাইটি অফ উত্তর দিনাজপুর – নামের ইতিহাস বিষয় কেন্দ্রিক এক সংস্থার উদ্যোগে সংস্থার বেশ কিছু নবীন ও প্রবীন সদস্যরা মিলে উপস্থিত হয়েছিল উওর দিনাজপুর জেলার কাঠের মুখোশ তৈরি ও মুখোশ বা মোখা নাচের অন্যতম কেন্দ্র হেমতাবাদ থানার কৃষ্ণবাটি অঞ্চলে। সেখানে অন্যতম প্রবীন মোখা শিল্পী শচীন্দ্র নাথ সরকারের বাড়ি।
গ্রাম বাংলার প্রাচীন লোকসংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ মুখোশ। সংস্থার সদস্যদের মতে আমাদের জেলা থেকে হারিয়ে যেতে বসা গ্রাম বাংলার এই প্রাচীন সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে ও জেলার মুখোশ তৈরি করবার গ্রাম বাংলার প্রাচীন হস্তশিল্পকে বিশ্বের দরবারে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে দিতে এই শিল্পের প্রচার প্রয়োজন ও বিভিন্ন উপায়ে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের মধ্যে এই শিল্প সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি করতে হবে, তাই আমাদের সবার উচিত শিল্প ও শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের শৈল্পিক কাজগুলিকে জনসমক্ষে বারবার তুলে ধরা, শিল্পীদের উৎসাহিত করা এবং একই সঙ্গে শিল্পীদের সৃষ্টির রুপরেখাকেও নতুন প্রজন্মের কাছে বারবার তুলে ধরা, তবেই গ্রাম বাংলার প্রাচীন এই মোখা শিল্প মাথা তুলে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
জেলার অন্যতম প্রাচীন লোক ঐতিহ্য হল মুখোশ ও তার নৃত্যকলা মোখা নৃত্য। পুরুলিয়ার ছৌ ও দিনাজপুরের গম্ভীরা সমসাময়িক লোক নৃত্যকলা হলেও শুধুমাত্র প্রচার, প্রসার এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ গম্ভীরা মুখোশ নৃত্য জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। সমগ্র বিশ্ব মানবীয় সভ্যতার সঙ্গে বাংলা তথা দিনাজপুরের মুখোশেও ঐতিহ্য, পরম্পরা ও শিল্পকর্মের এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে। আমাদের দুই দিনাজপুরের মাটি মুখোশ সংস্কৃতির বর্ণময় বিচিত্রতার ধারক ও বাহক। এখনও এই মুখোশের উৎস বা প্রচলনের বিষয়টি এক রহস্যময় ইতিহাসের মধ্যেই রয়ে গেছে। অশুভ শক্তিকে বিনাশ এবং শুভ শক্তিকে আহবান জানাতে, দেবতাদের তুষ্ট করবার জন্য গ্রামবাসেইরা এই নৃত্য পরিবেশন করেন। বছরের বিভিন্ন সময়ে গ্রাম বাংলায় গ্রাম ঠাকুরের বিভিন্ন পুজোকে কেন্দ্র করে গম্ভীরার এই মুখোশ নৃত্য পরিবেশিত হলেও মূলত বাংলার বৈশাখ, জৌষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে বিভিন্ন গ্রামীন উৎসবের মধ্যে দিয়ে এই গমীরার মুখোশ নৃত্য বেশি লক্ষ্য করা যায়। গমীরার কাঠের মুখোশ এর বিবিধ রুপ রয়েছে, যেমন – চামুণ্ডা, শিকনিঢাল, মাশানকালী, ডাকিনী,বাঘ, বুড়া বুড়ি, নর -রাক্ষস, নরসিংহ অবতার ,মঙ্গলচন্ডী ,গনেশ ,অসুর ইত্যাদি। মূলত হলুদ,কালো ,লাল ও সাদা রং ব্যবহার করা হয় এই মুখোশ তৈরীর শিল্পে। গ্রামীন মানুষের বিশ্বাস এই গমীরা নৃত্যের সময় অলৌকিক শক্তি প্রবেশ করে নৃত্যশিল্পীদের শরীরে।
হেমতাবাদের কৃষ্ণবাটি অঞ্চলটি খুব পরিচিত নাম জেলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মুখোশ শিল্পের জন্য। এই অঞ্চলের একজন খ্যাতনামা প্রবীন মুখোশ শিল্পী হলেন সচিন্দ্র নাথ সরকার। ১৯৭৪ সাল থেকে তিনি মুখোশ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি ও তার বড় ছেলে শক্তিধর সরকার এই মুখোশ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তাদের মুখোশ দলের নাম ‘উত্তরবঙ্গ মুখোশ দল’, যে দলে বর্তমানে ২৫ জন সদস্য রয়েছে। শিল্পী সচিন্দ্র নাথ সরকার কি জানিয়েছেন শুনে নেব-
প্রবীন এই শিল্পীর সঙ্গে একমত হয়ে হিস্টরিক্যাল সোসাইটি অফ উত্তর দিনাজপুর- নামের সংস্থা জেলায় এই প্রাচীন মুখোশ শিল্পের উন্নতিকল্পে বেশ কিছু মতামত উপস্থাপন করেছে। সেগুলি হলো -১. সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই দেশজ শিল্প সামগ্রী বিশ্ব দরবারে অনলাইনে বিপনন কীভাবে করা যায়, সরকার কর্তৃক তার সঠিক রুপরেখা তৈরী করা। ২.গ্রাম বাংলার এই প্রাচীন শিল্পকার্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের মধ্যে জানবার আগ্রহ ও শিল্পের প্রসারের উদ্দেশ্যে মঝে মধ্যে বিভিন্ন স্কুল , কলেজ ও পাড়ায় পাড়ায় শিল্পীদের দ্বারা মুখোশ নৃত্য পরিবেশন ও আলোচনা চক্রের ব্যবস্থা করা। ৩.জেলার বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে জেলার মুখোশ শিল্পীদের মুখোশ নৃত্য পরিবেশন করবার সুযোগ করে দেওয়া। ৪. মুখোশ শিল্পের উন্নতিকল্পে সরকার কর্তৃক কিছু বিশেষ আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করা। ৫. নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের মুখোশ শিল্প সম্পর্কে সঠিকভাবে প্রশিক্ষনের জন্য সরকার কতৃক উপযুক্ত প্রশিক্ষন শিবিরের ব্যবস্থা করা।
এদিন সংস্থার পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন সম্পাদক সোমনাথ সিং, সহ-সভাপতি গৌতম চক্রবর্তী, যুগ্ম সহ সম্পাদক শৈবাল কর্মকার ও কোয়েল গুন দাস , কোষাধ্যক্ষ শুভ সরকার-সহ পার্থ বোস, শুভ সরকার,সৌকত দত্ত, ক্যাটরিনা আঞ্জুম, দেবপ্রীয়া রায়, পিঙ্কি বর্মন প্রায় ২৫ জনের মতো নবীন ও প্রবীন সদস্যরা।
উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদ থেকে নিজস্ব প্রতিনিধির রিপোর্ট, টাইমস ফোর্টিন বাংলা।