গর্বের মাস (Pride month) চলছে গোটা জুন মাস জুড়ে। রামধনু রঙের ছড়াছড়ি চারদিকে। কেননা রামধনু রঙের পতাকাই হল এই এলজিবিটিকিউ (LGBTQ) সম্প্রদায়ের প্রতীক। এই পতাকার উৎসস্থল নর্দার্ন ক্যালিফোর্নিয়া হলেও, এখন এটি সারা বিশ্বেই ব্যবহৃত হয়। ১৯৭৮ সালে সানফ্রান্সিসকোর এক চিত্রশিল্পী গিলবার্ট বেকার এই রামধনু পতাকার নকশা প্রস্তুত করেছিলেন। যিনি নিজেও একজন সমকামী ছিলেন। ওই বছরই নভেম্বর মাসে সানফ্রান্সিসকোর সিটি সুপারভাইজার এক পুরুষ সমকামী নিহত হন। এরপর থেকেই এই রামধনু পতাকার চাহিদা বাড়তে শরু করে।
চিত্রশিল্পী গিলবার্ট বেকার এই পতাকা তৈরির প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, “রামধনুর এই রঙ বেছে নেওয়ার পেছনে এক বিশেষ কারণ আছে। আসলে সমকামিতা তো প্রকৃতিরই অংশ, এক কথায় প্রাকৃতিক। সে সম্পর্কে যে যাই বলুক, আমি এটা প্রকৃতিরই অংশ হিসেবে মানি। তাই আমি রামধনুর সাত রঙকে বেছে নিয়েছি, যা কিনা প্রকৃতির মাঝেই রয়েছে। আমার কাছে এই সমকামিতার প্রতীক তৈরি করাটা রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি আসলে এমন কিছু তৈরি করতে চাইছিলাম যাতে সমাজ বুঝতে পারে সমকামীরাও মানুষ।”
সমকামিতার রঙের মধ্যে হট পিংক যার অর্থ যৌনতা, লাল অর্থাৎ জীবন, কমলার অর্থ আরোগ্য, হলুদ হল সূর্যালোক, সবুজ বলতে প্রকৃতি, আশমানি নীলের অর্থ জাদু, গাঢ় নীল অর্থাৎ শান্তভাব, আর বেগুনির অর্থ উদ্দীপনা। সমকামিতার অর্থ যে শুধুওই যৌনতা নয়, তা এই পতাকার সাত রঙই বলে দেয়।
এবার এই সাত রঙ নিয়েই শুরু হল বিপত্তি। সমকামী অধিকার আন্দোলনের প্রতীক হওয়ার দরুণ এবার রামধনু রঙের সমস্তরকম পণ্য নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করতে শুরু করেছে সৌদি আরব। সম্প্রতিই, সমকামী চুম্বনের দৃশ্য থাকায় তারা ডিজনির ‘লাইটইয়ার‘ ছবিটি দেশ জুড়ে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছে। এবার সমকামিতার রঙের বিরুদ্ধেও অভিযান চালাচ্ছে দেশ। সৌদি আরবের সমস্ত দোকান, শপিং মল, সুপার মার্কেটে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে পুলিশবাহিনী।
উল্লেখ্য, ওইসব দোকানগুলি থেকে রামধনু রঙের জামাকাপড়, টুপি, সোয়েটার, মাফলার, বাচ্চাদের বিভিন্নরকম খেলনা, পেন্সিল বক্স, বো-টাই, বেল্ট ইত্যাদি আরও নানা সামগ্রী তারা নিজেদের হেফাজতে রাখছে। এই রঙের জিনিস যাতে বিক্রি না করা হয়, সেই নির্দেশই দিয়েছে দেশ। অভিযানকারীদের বক্তব্য, এমন সমস্ত জিনিসগুলিকে তারা জব্দ করছে, যেগুলি ইসলামিক বিশ্বাস এবং জনসাধারণের নৈতিকতার সঙ্গে সংঘর্ষ সৃষ্টি করে। এবং তরুণ প্রজন্মকে লক্ষ্য করে সমকামিতার রঙকে প্রচার করে।
তাঁদের আরও বক্তব্য, আমরা আমাদের দেশের তরুণ-তরুণী এবং শিশুদের এই বিষাক্ত বার্তা থেকে দূরে রাখতে চাই। আমাদের কাছে সমকামিতা হল অপরাধ, যা কোনওভাবেই স্বাভাবিক আচরণ নয়। প্রসঙ্গত, সৌদি আরবে সমকামিতার এই অতিরিক্ত বিরুদ্ধতার সূত্রপাতই হল ডিজনির লাইটইয়ার চলচ্চিত্রে দুই মহিলা সমকামীর চুম্বন দৃশ্য। এই ছবি বাতিলের পর থেকেই তারা আরও উঠে পড়ে লেগেছে দেশ থেকে সমকামিতার চিহ্ন পুরোপুরিভাবে মুছে ফেলার লক্ষ্যে। সমকামিতা তাদের কাছে উগ্রবাদের নামান্তর।
সৌদি আরবে এখনও পর্যন্ত সমকামিতা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। সেখানকার সামাজিক বিধান এবং আইন দুটোই অধিক রক্ষনশীল মুসলিম জাতির দ্বারা প্রভাবিত। তারা এই সমকাম এবং রূপান্তরকামকে অশ্লীল বলে মনে করে। এমনকি গত ২০১৫ সালে সৌদি আরবের এক সমকামী ঘোড়াকে মৃত্যদণ্ডের আদেশ পর্যন্ত দেওয়া হয়। এর আগে ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অফ ম্যাডনেস’ চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ করেছিল সেই দেশ। তার একটাই কারণ, এই সমকামিতা। তারও আগে ‘ইন্টারনালস‘ নামক আরেকটি সিনেমা এই একই কারণে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় সৌদি আরবে। ওই সিনেমাতে সমলিঙ্গের দম্পতি এবং প্রথম একজন সমকামী সুপারহিরোর জীবন কাহিনী দৃশ্যায়িত হয়।
সমকামিতার বিরুদ্ধচারী দেশ শুধু সৌদি আরবই নয়, ইরান, সুদান, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, মরিতানিয়া, সোমালিয়া প্রভৃতি দেশগুলি আজও সমকামিতাকে গ্রহণ করতে পারেনি। তবে, তাই বলে এমনটা তো নয় যে সৌদি আরবে কোনও সমকামী ব্যক্তি জন্মায়ইনি। এর আগে এক টিভি শো তে দুই সমকামী সৌদি নারী তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে মুখ খুলেছিল। এমনকি, সৌদি আরবের এক সমকামী রাজপুত্রও ছিল।